ছোট গল্প / নেতা
নেতা
( অভিজিত চন্দ )
- আমাদের ইঠিনে কুন ঝামেলা নাই সার । গাঁয়ের লুকে সব লাইনে ডাঁড়ায়ে ভোট দিবে । একদম শান্তিসে । দেইখে লিবেন ।
ইলেকশান টিম বাস থেকে নামতেই, ছোটখাটো ভিড় জমে গেছে তাদের ঘিরে । কথাগুলো কে বলল ঠিক বোঝা গেল না । যেই বলুক, ভিড়ের বাকি সবাই হৈ হৈ করে তাকে সমর্থন করলো । ভোট নিতে আসা সরকারি দলটির সব চেয়ে প্রবীণ, প্রিসাইডিং অফিসার, ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
- তাই ? বাঃ, তা হলে তো ভালোই । আপনাদের গ্রাম । আপনারাই থাকবেন । অশান্তি না হলেই তো মঙ্গল ।
মাতব্বর গোছের লোকটি এবার সামনে এগিয়ে এল । পরনে একটা ময়লা জিনসের জামা, আর লালচে হয়ে আসা সাদা টেরিলিনের প্যান্ট । জামার বোতাম ওপর থেকে তিনটে খোলা । গলায় কালো কারে ঝোলানো বড় একটা তাবিজ । মুখ চোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট । ইলেকশনের চক্করে কত দিন যেন ঠিক করে ঘুমায়নি লোকটা । তবু কালো দাঁত বার করা হাসিতে, পোলিং পার্টিকে স্বাগত জানিয়ে বলল,
- আপনাদের কুন অসুবিধা হবেক নাই । সব ব্যবস্থা আছে । তবে ভোট কিন্তু নব্বই পারসেন হয় ইঠিনে ।
- বলেন কী ? এত ? তাহলে তো ভোট শেষ হতে হতে রাত হয়ে যাবে । তেরশো ছাপ্পান্ন ভোটার আপনাদের বুথে । তার ৯০শতাংশ মানে তো প্রায় বারোশো ভোট । সেকি চাট্টিখানি কথা ?
- হঁ, তা বারশো ভোট তো পড়েই । তবে রাত হবেক নাই । সইঞ্ঝার আগেই খতম কইরে দিব ।
লোকটার কথা বার্তায় এমন একটা প্রত্যয়, যেন বিধাতা পুরুষ । যা বলছে তার অন্যথা হওয়ার নয় । গলিতে বাস ঢুকবে না বলে একটু দূরে বড় রাস্তার উপর দাঁড়িয়েছে সেটি । তারপর ভোট মেশিন, কাগজ পত্র, অন্যান্য সামগ্রী হাতে ঝুলিয়ে, গ্রামের একমাত্র প্রাইমারি স্কুলের উদ্দেশে চলেছে পোলিং পার্টি ।
...
বুথের চেহারা দেখে আঁতকে উঠলেন প্রিসাইডিং অফিসার সামন্তবাবু,
- একি ? এখানে ভোট হবে ? এটা বুথ ?
পাশের শহর থেকে, ভোটের জন্য, তুলে আনা হয়েছে তাঁদের । এ শহরের পুরসভা নির্বাচন । শহরের মধ্যে যে এমন অজ গাঁ আছে তাই জানা ছিল না । তার ওপর, এখন বুথের এই চেহারা দেখে চোখ কপালে ওঠার যোগাড় । মাথায় খাপড়ার চাল, ঝুরঝুরে পোড়ো বাড়িটায় নাকি, নিয়মিত বাচ্চাদের ক্লাস হয় ।
সামন্তবাবু নিজেও একটি স্কুলে ভুগোলের টিচার । এই গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের ভূগোল দেখে একটু দমে গেলেন । দুটো পাকা, আর দুটো খাপরার ঘর আছে স্কুলে । ভোটের জন্য বরাদ্দ খাপরার ঘরগুলো । এসিআরের টাকায় তৈরি হওয়া অপেক্ষাকৃত ভালো ঘরগুলোয় তালা মারা । চাবি বড় দিদিমনির কাছে । বুথ নাকি এই বড় ঘরটাতেই হয় প্রতি বার । পাশের ছোট ঘরটা পুলিশ পার্টির জন্য বরাদ্দ । তারপাশে আরেকটা ছোট ঘর । মিড ডে মিলের রান্না হয় সেখানে । বিশাল মাটির উনান মেজেতে গাঁথা । আর বড়সড় একটা চৌবাচ্চা । জলে টইটম্বুর । ওই জল দিয়েই সব কাজ সারতে হবে । চান পায়খানা হাতমুখ ধোয়া, সব ।
পায়খানার কথা মনে পড়তেই, পিঠের ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে উঠল যেন । ডাক্তার সেন পই পই করে বলে দিয়েছেন, কমোড ব্যবহার করতে । নইলে শিরদাঁড়ার এ ব্যথা কমবে না । এখন ভোটের ডিউটিতে কমোড কোথায় পাবেন ? ভাবতেই হাসি পেল সামন্তবাবুর । তবে কমোড না থাক, ইন্ডিয়ান প্যান আছে নিশ্চয়ই ? সচ্ছ ভারত, নির্মল বাংলা, ইত্যাদি অভিযান তো কম হল না ।
- ইয়ে, স্কুলের পায়খানাটা কোথায় যেন ?
মাঠের মাঝে, একলা তাল গাছের মত, একটা স্যানিটারি পায়খানা আছে বটে । কিন্তু ব্যবহার হয় না । ময়লা জমে কালো হয়ে আছে প্যান । দরজার তলাটা পচে গিয়ে হাঁ হয়ে আছে । চান করার ব্যবস্থা ওই রান্নাঘরে । চৌবাচ্চা থেকে মগে করে জল নিয়ে মাথায় ঢালতে হবে । এই ‘রাজকীয়’ ব্যবস্থা দেখে মনটা ভারি হয়ে গেল । ডিউটি তো নয় যেন পানিশমেন্ট । এখন ভালোয় ভালোয় সব কিছু মিটিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতে পারলে হয় ।
মাতব্বর ছেলেটি যে এ অঞ্চলের নেতা, বোঝাই যাচ্ছে । কিন্তু কোন পার্টি ? রুলিং পার্টি নিশ্চয়ই । না হলে এত বোলচাল হত না । মনে মনে কি হিসেব কষে, ওকেই ডাকলেন ভদ্রলোক ।
- এই যে ভাই, আপনার নামটা যেন কী ?
- আমার নাম গ’পাল । গ’পাল হাঁসদা । ইঠিনে সবাই আমকে, কালা গ’পলা বইলে চিনে ।
- অ, তা বলছিলাম, আপনিতো রুলিং পার্টির, তাই না ?
কালো দাঁতগুলো আবার ঝিকিয়ে উঠল গোপালের । কান এঁটো করে সম্মতি জানালো সে কথার ।
- এজ্ঞে, আমি এই বুথ কমিটির পেরসিডেন বটি । মন্ত্রী মশাই লিজে আমকে এই বুথের ভার দিনছেন । আপনাদের কুন অসুবিদা হইলে আমকে বইলবেন । তুরন্ত ব্যবস্থা হঁইন যাবে ।
- বলছিলাম, এই প্যানটা পরিষ্কার করার লোক, মানে মেথর পাওয়া যাবে একটা ?
কালা গ’পলা যেন এটাই চাইছিল । হাঁকডাক করে লোক জন এনে প্যান পরিষ্কার করে দিল । পোলিং পার্টিকে চা খাওয়াল । ইলেকট্রিশিয়ান ধরে নিয়ে এসে খাপড়ার ঘরে আলো পাখার ব্যবস্থা করলো । রাতের খাবারের ব্যবস্থাও আছে । চিন্তা করতে হবে না, বলে অভিজ্ঞ প্রিসাইডিং অফিসারের চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিল । তারপর দলের দু’তিন জনকে ভোট পাটির খিদমতে রেখে, নিজে কোথায় জানি ‘কাজে’ গেল । যাওয়ার আগে বলে গেল,
- সার, আপনারা ইবার কাজ কাম শুরু করেন । আমি রেইতে ঘুরে আইসব । ই ছিলাগ’লাকে যা বইলবেন কইরে দিবে । খালি কাল ভোটে, একটু দেইখবেন । আর হঁ, আপনার নামট যদি দয়া কইরে বলেন । মন্ত্রী মশাই শুধাইছিলেন ।
- নাম ? আমার নাম মন্ত্রী মশাই জেনে কী করবেন ?
- তা বইলতে লাইরব । তবে উনি ফোন কইরেছিলেন । আপনার নামট শুধাতে ।
গম্ভীর মুখে সামন্ত স্যার পকেট থেকে নিজের আইডেন্টিটি কার্ডটা বার করে দিলেন । যাতে ছবিসহ তাঁর নাম, ডেজিগনেশন, বুথ নম্বর ইত্যাদি সব লেখা আছে । কালা গ’পলা পকেট থেকে দামি অ্যানড্রয়েড ফোন বার করে ঝট করে সেটির ছবি তুলে নিল । তারপর তার ‘কাজে’ চলে গেল ।
আই কার্ডটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল সামন্তবাবুর । মনে পড়ে গেল পুরনো কিছু ভোটের স্মৃতি । তখন অবশ্য রুলিং পার্টি আলাদা ছিল । তাদের কাজ করার ধরণও ছিল আলাদা । এই গ’পলার মত কেউ, এসে নাম জানতে চাইতো না । বরং নাম, ঠিকানা, কোথায় কতদিন চাকরি, বাড়িতে কে কে আছে, সব লিস্টি ধরে নিয়ে আসতো । ইলেকশন সেল থেকেই কি করে যেন সেই লিস্টি হাতে চলে আসত তাদের । তারপর মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে দিত, যা বোঝানোর ।
এখন গ’পলারা ক্ষমতায় । ‘কাজের’ ধরণটা পাল্টালেও মোদ্দা ব্যাপারটা একই আছে । কিছুই বদলায়নি । কাল ভোট কেমন হবে আঁচ করে আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সামন্তস্যার ।
***
সকাল বেলা, সামন্তবাবু যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে । নটার মধ্যে ডিসিআরসি পৌঁছানোর কথা । তিনি প্রিসাইডিং অফিসার । মানে দলপতি । তাঁর দিকেই চেয়ে থাকবে দলের সবাই । তাই বাধ্য হয়ে, বৃষ্টি মাথায় করেই বেরোতে হল । ছাতা ছিল অবশ্য । তবু বাস স্ট্যান্ড অবধি আসতে, আধ ভেজা হয়ে গেলেন । বাসে চাপার খানিক পরেই বৃষ্টি থেমে গেল । আর সারা দিন হয়নি । এখন বোঝার উপর শাকের আঁটির মত, ছাতাটাকেও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে । জ্বালাতন ।
ফার্স্ট পোলিং অফিসার ছেলেটি বেশ সপ্রতিভ । এলআইসিতে আছে । ট্রেনিঙের দিন প্রথম আলাপ । নাম সুকোমল গড়াই । কাজ করার আগ্রহ আছে । তবে অভিজ্ঞতা নেই । বেশ পিকনিক পিকনিক মুডে ঘুরে বেড়াচ্ছে । সেলফি তুলে পোস্ট করছে । কতই বা বয়স ? বড় জোর সাতাশ আঠাশ । এসেই চান টান করে থ্রি-কোয়ার্টার বারমুডা পরে ফিটফাট ।
দু’জন সেকেন্ড পোলিং দিয়েছে এবার । একজন থার্ড । আগে দিত একজন করে সেকেন্ড, থার্ড, ফোর্থ অফিসার । হরেদরে সেই পাঁচ জনের টিম । আগে যা ছিল এখনও তাই । কিছুই বদলায়নি ।
ও হ্যাঁ, একটা নতুন জিনিস জুড়েছে এবার । ক্যামেরা ম্যান । বাচ্চা বাচ্চা কতকগুলো ছেলে, একটা করে এনড্রয়েড ফোন হাতে নিয়ে, পোলিং টিমের সঙ্গে জুড়ে গেছে । ওরা ছবি তুলবে । বেসরকারি কোন এজেন্সি, ভোটের কাজের বরাত পেয়েছে । ভবিষ্যতে ভোট গ্রহনের কাজটাও ঠিকায় দিয়ে দিলে কেমন হয় ? এই নরক যন্ত্রণা থেকে সরকারি চাকুরেদের এবার মুক্তি দেয়া উচিৎ ।
সেকেন্ড পোলিং অফিসার দু’জনের একজন আবার হিন্দিভাষী । কোল ইন্ডিয়ার চাকুরে । কাজ তো জানেই না । শেখার আগ্রহও নেই । ভোটের ডিউটি সেরে ফিরে গেলেই কোম্পানি ওদের প্রত্যেককে সাড়ে ন’হাজার টাকা দেবে । ওভারটাইম হিসাবে । সেই আনন্দেই মশগুল ।
অপর জন, প্রাণকৃষ্ণ হালদার, প্রাইমারি স্কুল টিচার । বয়স প্রায় পঞ্চাশ । আগে বহু নির্বাচন পার করেছেন । এই দলে সামন্ত বাবুর বড় ভরসা ।
থার্ড পোলিং নিবারণকে দেখে সামন্ত বাবুর নিজের স্কুলের দপ্তরি ইকবালকে মনে পড়ে গেল । নিবারণবাবু একটা কলেজের গ্রুপ ডি স্টাফ । ইকবালের মতই যা বলছেন হাসি মুখে করে দিচ্ছে । ভোটের ব্যাগ ঘেঁটে কার্বলিক অ্যাসিডের শিশিটা বার করে, সব গর্তের মুখে, দরজার কাছে, ছড়িয়ে দিয়েছে । গন্ধে সাপ কেন ভূতও পালিয়েছে নির্ঘাত । এবার গা ধুয়ে এসে কাগজ পত্র নিয়ে বসতে হবে । অনেক কাজ বাকি ।
ভোটের ডিউটি করতে গিয়ে, আজও একটা ব্যাপারে আকর্ষণ বোধ করেন সামন্তবাবু । এতগুলো নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয় । এক সাথে রাত কাটানো । থাকা, খাওয়া । কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা । প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈন্যদলের মত । পুরো পর্বটা, যেন একটা মিশন । যে কাজে ভুল হলেই বিপদ । দেশের জন্য কার্গিল বা দ্রাস সেক্টরে বন্দুক নিয়ে দাঁড়াতে হয় না বটে, কিন্তু পালাবদলের যুদ্ধকে এত কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্যই বা ক’জনের হয় ?
...
সারা দিন হয়রানির শেষে, দু’মগ ঠান্ডা জল গায়ে ঢেলে বেশ আরাম হল । একটু পাউডার লাগাতে পারলে ভালো হত । যাকগে । অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে, ভোটের ডিউটিতে লাগেজ যত কম হয় তত মঙ্গল । এই যেমন, বাড়িতে বারমুডা পরেন । শীতকালে পাজামা । কিন্তু ভোটের কাজে আদাড়ে বাদাড়ে ডিউটি পড়ে । মাঠে ঘাটে যেতে হয় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে । তখন লুঙ্গির জবাব নেই । লুঙ্গি, গামছা, দুটো বেডকভার, আর এক সেট জামা প্যান্ট । আর একটা বাটি চামচ ও এক প্যাকেট ছাতু-চিনি । ব্যাস, ভোটের লাগেজ রেডি ।
লুঙ্গিটাকে পেটের উপর কষে বেঁধে, খালি গায়ে, শতরঞ্চির উপর জমিয়ে বসলেন । দু’দিকে দুটো মশার কয়েল জ্বেলে । সুকোমল আর প্রাণকৃষ্ণবাবুকেও ডেকে নিলেন । নিবারণকে বললেন সমস্ত কাগজ, খাম ইত্যাদিতে স্ট্যাম্প মারতে । এই বুথের ডিস্টিংগুইশিং মার্ক । নিজে ঝটপট সই-সাবুদ করে, ফিলআপ করতে লাগলেন যাবতীয় ফর্ম । যে গুলো দু’তিন কপি লাগবে, বাড়িয়ে দিলেন সুকোমল আর প্রাণকৃষ্ণবাবুর দিকে । ঘন্টা খানেকের মধ্যে এগিয়ে গেল কাজ । জরুরি আর অতি জরুরি এই দুই ভাগে সাজিয়ে রাখলেন খামগুলো । কাল ভোট শেষ হলেই এ’গুলোর দরকার পড়বে । আশা করা যায়, ভোট মিটলে আর বেশিক্ষণ লাগবে না । আধ ঘন্টা চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই সব গুটিয়ে পাটিয়ে রওনা দেয়া যাবে । এখন ভালোয় ভালোয় ভোটপর্ব মিটলে হয় ।
রাত আটটায় সেক্টর অফিস থেকে দু’জন এলেন । কোন অসুবিধা আছে কিনা জানতে । এই সেক্টর অফিসারদের দেখলে আজকাল হাসি পায় সামন্তবাবুর । ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার । আট-দশটা বুথের চার্জ । একটা গাড়ি নিয়ে ঘুরতে থাকো ।
সামন্তবাবু কিছু বলার আগেই, সুকোমল আর তেওয়ারি রীতিমত ঝাঁঝিয়ে উঠল । বুথের হাল এত খারাপ... কেউ আগে থেকে দেখেনি কেন... এই পোড়ো বাড়িতে কি ভোট হয় ? বৃষ্টি নামলে কী হবে ? ইত্যাদি...প্রভৃতি... । বেচারিরা হকচকিয়ে গিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো । তাঁরাও ভোটের ডিউটির ভাড়া করা সৈনিক । এমন প্রতিরোধের মুখে পড়বে ভাবতে পারেনি ।
শেষে সামন্তবাবুই সমাধান সূত্র বাতলালেন । বিকেল বেলা এসে থেকে যা কিছু করাতে হয়েছে, মানে ওই পায়খানা পরিষ্কার, ইলেকট্রিক আলো, ফ্যান, ইত্যাদির খরচ সেক্টর অফিস দিয়ে দেবে । কন্টিঞ্জেন্সির তিনশো টাকা পাওয়া যায় এই বাবদ । প্রিসাইডিং অফিসার হিসাবে তিনি আগেই তা পেয়ে গেছেন । মনে মনে ভেবে নিলেন, ওই টাকার সঙ্গে আরো কিছু মিলিয়ে, সবার এই দু’দিনের খাবারের বিলটা মিটিয়ে দেবেন । দলকে ঠিক মত চালাতে গেলে, দলপতিকে উদার হতে হয় । সংকীর্ণ-মনা ক্যাপটেনকে কেউ পছন্দ করে না ।
কিন্তু রাতের খাবারটা কখন আসবে ? গোপাল ডোবাবে না তো ?
***
গ’পলা এল রাত পৌনে দশটা নাগাদ । চোখে মুখে সেই যুদ্ধ জয়ের হাসি । হাতে প্ল্যাস্টিকের ক্যারি ব্যাগে রুটি, ডিমের তরকারি । থালা বা পাতা-টাতার বালাই নেই । সবার হাতে হাতে একটা করে ক্যারি ব্যাগ ধরিয়ে দিল । একটা করে ডিম আর চার টুকরো আলু, ঝোল সমেত । রুটির ঠোঙ্গাটা রাখল টেবিলের ওপরে । প্রয়োজন মত নিয়ে নিতে হবে ।
নিবারণ ভাত খাবে বলেছিল । তার জন্য ভাত এসেছে । একটা ক্যারি ব্যাগে । আলাদা প্লাস্টিকে ডাল । আরেকটাতে ডিমের ঝোল । বেচারা, খানিকক্ষণ এদিক ওদিক দেখে, ওই ভাতের প্লাস্টিকেই ডাল, ডিমের ঝোল সব ঢেলে নিল । তারপর ঠোঙ্গা থেকে মুড়ি খাওয়ার মতন, হাত ডুবিয়ে, ভাতের মিশালি খেতে লাগলো । খাওয়া মানে তো উদর পূর্তি । নিবারণকে ওইভাবে ভাত খেতে দেখে আরেক বার সে কথা টের পেলেন সামন্তবাবু ।
গোপালকে ডেকে টাকা পয়সার কথাটা এই বেলা সেরে নেওয়া দরকার । রুটিতে হাত দেওয়ার আগে প্রিসাইডিং অফিসার বললেন,
- গোপালবাবু, শুনুন । সেক্টর অফিস থেকে লোক এসেছিল । ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বা লাইট ফ্যানের ভাড়া এবং বাথরুম পরিষ্কার করার বিল বানিয়ে দেবেন । সেক্টর অফিস দিয়ে দেবে বলেছে । আর বিকেলের চা, রাতের খাবার, কাল সকাল ও দুপুরের খাবারের পয়সা আমার কাছ থেকে নেবেন । একসঙ্গে সব হিসাব করে, কাল যাওয়ার আগে বলবেন ।
- ইটো কী বইলছেন সার ? আপনারা হইলেন যাঁইয়ে আমাদের গাঁয়ের গেস্ট । ই গাঁয়ে তো কুন খাবারের দুকান নাই । একজনের ঘরকে যাঁইয়ে, রাজি করায়েঁ, ডাঁড়াই থেইকে রুটি-তুটি বেনা করাইলম । এখন পয়সা লিতে বইলছেন ? না সার, উটি পাইরব নাই । অধম্ম হবেক । তবে সেক্টর অফিসে বিল দুব । কে আইসেছিল, বেনাজ্জি সাহেব নকি ?
- তা তো বলতে পারবো না । দু’জন এসেছিলেন । কিন্তু ভাইটি, দাম না নিলে যে আমিও খেতে পারবো না ।
- ই বাবা, ভাই বইলছেন, আবার দামও দিতে খুঁইজছেন ? আচ্ছা, সে হবে খন । এখন তো খান আইজ্ঞা । রুটি গুলা শুখাইন যেইছে । পয়সা কড়ির হিসাব, কাল দেখা যাবেক ।
সামন্তবাবু আর কথা বাড়ালেন না । মাথা ঠান্ডা রেখে ভোট পর্ব সমাধা করাই কাজ । দু’হাতে রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন,
- কাল কিন্তু ছটার মধ্যে চলে আসবেন । মক পোল করতে হবে । সই সাবুদ করে, মেশিন সিল করতে হবে । অনেকটা সময় লাগবে । দেরি করলে ভোট আরম্ভ করতে দেরি হয়ে যাবে । আর জানেন কি, অন্য পার্টির কে কে পোলিং এজেন্ট হবে ? জানলে তাদেরকেও খবর দিয়ে দেবেন । আজ তো কেউই এল না একবার দেখা করতে । কাল দেরি করলে মুশকিল ।
- কেওই আইসবে নাই আইজ্ঞা । আজও না কালও না । আপনি নিশ্চিন্তি থাইকতে পারেন ।
- অ্যাঁ, কেউ আসবে না ? সেকি ? এই ওয়ার্ডে তো শুনেছি আপনাদের কাউন্সিলার ছিল না । ওই নীল পার্টির ছিল । তারাও কেউ আসবে না ?
- ঠিকেই শুইনেছেন । গেল বারে ই ওয়ার্ডে আমরা হাইরেছিলম । নীল পাটির কেনডিডেট জিতেছিল । বোর্ডও উয়ারা পাইয়েঁছিল । কিন্তু কুন কাজ করে নাই । উয়ার লেগেই ত, দেইখছেন নাই কমন হাল কইরেছে ওয়ার্ডটর । ইবার আর ভোট চাইবার মুখ আছে উয়াদের ? গাঁয়ের লোক খেইপে আছে । একটাও ভোট উয়াদের দিবে না ।
প্রবীণ প্রিসাইডিং আর কিছু বললেন না । আগামী কালের ভোটচিত্র আঁচ করে কিঞ্চিৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন । আর কী যেন বিড় বিড় করতে লাগলেন ।
...
দু’শো ওয়াটের দুটো বাল্ব, চোখের উপর জ্বলতে থাকলে কি ঘুম হয় ? চোখের পাতা বন্ধ করেও জোরালো আলোর উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে । হাল্কা লালচে আভা ফুটে উঠছে বন্ধ পাতার ভিতর দিয়ে । জীবন বিজ্ঞানের টিচার সুমনা দিদিমণি থাকলে এখুনি বুঝিয়ে দিত সব । চোখের পাতা আসলে অর্ধস্বচ্ছ পর্দার মত । পাতলা পেশী ও চামড়ার আস্তরণ । ভিতরে অগুনতি রক্তজালিকা । জোরালো আলোয় সেই রক্তজালিকার লালচে আভা দেখা যাচ্ছে ।
মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় একটা খেলা খেলতেন স্কুলে । সুজয় শিখিয়েছিল । হাতে মুখ ঢেকে, সুর্যের দিকে ফিরে দাঁড়াতে হত । হাতের উল্টো পিঠে সকালের মিঠে রোদ এসে পড়ত । কচি হাতের তালু ভেদ করে সে রোদ চোখে না পৌঁছালেও, লাল টকটকে আভাটা ঠিক ধরা পড়ত । আহা কী নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক ছিল শৈশবের সেই সব দিন । আজ এত বছর পরে আবার যেন শৈশবে ফিরে গেছেন । চোখের পাতায় সেই লাল আভা দেখতে পাচ্ছেন । গনগনে লাল কয়লার আগুন যেন । আঙ্গুলের ফাঁক গলে ছিটকে আসছে রোদ্দুরের চ্ছ্বটা । আগুনের শিখা যেমন ছিটকায় । সে আগুনের মধ্যে একে একে ফুটে উঠছে ক্লাস ওয়ানের বন্ধুদের মুখগুলো । ওই তো সুজয়, ইন্দ্র, অমিত । সবাই চোখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে । আর মাঝে মাঝে হেসে গড়িয়ে পড়ছে । বেশ মজার খেলা তো । সুজয়টার বুদ্ধি আছে । যাঃ, ঘন্টা পড়ে গেল । টিফিন শেষ । এবার অঙ্কের ক্লাস নেবেন তুষারবাবু । ছোট, ছোট ।
***
- আরে আরে, পড়ে যাবেন তো !
- আ...আমার মাথাটা কেমন ঘুরছে । দম বন্ধ হয়ে আসছে । গা-টা গোলাচ্ছে ।
- আপনি চেয়ারে বসে পড়ুন । না না শুয়েই পড়ুন । দাঁড়ান আপনার শোয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি । নিবারণবাবু শতরঞ্চিটা পাতুন তো ।
- না শুতে হবে না । আমি একটু বাইরে খোলা হাওয়ায় গিয়ে বসছি । আপনারা এদিকে সিল টিল করুন । মনে হচ্ছে গরম লেগেছে । একটু নুন চিনির জল খেতে হবে ।
- হ্যাঁ তাই হবে । তেওয়ারিজি, একটা বোতলে নুন-চিনির জল গুলে স্যারকে দিন তো । আমাদের জন্যও গুলুন এক বোতল । যা ঘাম বেরিয়েছে সবার । ডিহাইড্রেশন তো হওয়ারই কথা । আপনি স্যার সারা দিন কিছু খাননি । অন্যায় করেছেন । এখন ঘাড়ে মুখে চোখে জল দিয়ে হাওয়ায় বসুন । এদিকের কাজ সব হয়ে যাবে । চিন্তা করবেন না ।
প্রিসাইডিং অফিসার সামন্তবাবু ও সেকেন্ড পোলিং প্রাণকৃষ্ণবাবুর কথোপকথন । ভোট শেষ হতেই সামন্তবাবু অসুস্থ বোধ করছেন । ‘ভোট গ্রহণ শেষ’ ঘোষণা করে নিজের হাতে দরজার ছিটকানি লাগিয়েছেন তিনি । যাতে আর কেউ বুথে ঢুকতে না পারে । তারপরই মাথাটা যেন ঘুরে গেল । দরজাটা ধরে কোন রকমে সামলে নিলেন নিজেকে । নইলে হয়তো পড়েই যেতেন ।
ভোটার রেজিস্টার, মানে যে খাতায় ভোট দাতারা সই বা টিপ ছাপ দেন, সেটার দায়িত্ব প্রাণকৃষ্ণবাবুর । ভোট শেষ হতেই সেই রেজিস্টারে দাগ কাটতে লেগেছেন । লম্বা দাগ টেনে লিখে দিতে হয়, ‘ভোট ক্লোজড’ । শেষ কত সিরিয়াল নম্বর ভোট দিয়েছে, লিখতে হয় তাও । মেশিনের সঙ্গে মেলা চাই এই সংখ্যাটা । ব্যালট পেপার একাউন্টেও লাগবে । তারপর একটা খামে ভরে সিল করতে হবে খাতাটি । কোন অনিয়মের অভিযোগ থাকলে অডিট করা হবে এই রেজিস্টার ।
ভোটের কর্মকান্ডে এর গুরুত্ব অসীম । তাই ফাইনাল দাগটা টানার আগে একবার প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি নিতে চাইছিলেন প্রাণকৃষ্ণ । চাইছিলেন, মেশিনের ‘টোটাল’ বাটানটা টিপে একবার সংখ্যাটা মিলিয়ে নিন সামন্তবাবু । তাহলেই নিশ্চিন্তে রেজিস্টারের কাজ শেষ করতে পারেন উনি । সেই উদ্দেশ্যেই সামন্তবাবুর দিকে তাকান প্রাণকৃষ্ণ । তখনই দেখেন, দরজা ধরে কোনরকমে টাল সামলাচ্ছেন তিনি ।
হৈ হৈ করে ওঠেন সবাই । মুহূর্তে বুথের পরিস্থিতিটা বদলে যায় । এতক্ষণ আরো ভোট দিতে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছিল যারা, সেই গ’পলার সাঙ্গ-পাঙ্গরাও হতভম্ব । গ’পলাই দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে বুথ থেকে বার করে দিল । তারপর প্রিসাইডিং অফিসারকেও ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে বাইরে ফাঁকায় বসালো । সারা দিনের টেনশন এবং গরমে তখনও গলগল করে ঘামছেন তিনি । ঘাড়ে মাথায় চোখে মুখে জল ঢেলে রীতিমত ধুঁকছেন সামন্ত স্যার ।
ইতিমধ্যে বোতলে ভরে স্যালাইন জল বানিয়ে দিয়েছে নিবারণ । গোপালও কোল্ড ড্রিংক্সের বোতল আনিয়েছে পোলিং পার্টির জন্য । সামন্তবাবু যদিও নুন চিনির জলই খাচ্ছেন একটু একটু করে । একটা হাত পাখা যোগাড় হয়েছে কোত্থেকে । একজন হাওয়া করছে । এদের সমবেত শুশ্রূষায় ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন বৃদ্ধ ।
...
অথচ সকালটা কিন্তু দারুণ শুরু হয়েছিল । যাকে বলে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট । গোপালের কথা সত্যি করে অন্য কোন পার্টির কেউ আসেনি । না পোলিং এজেন্ট, না কোন প্রার্থী বা তার ইলেকশান এজেন্ট । একমাত্র গোপালরা তিনজন । একজন পোলিং এজেন্ট এবং দুজন রিলিভার । তাদেরই সামনে মক পোল করলেন সামন্তবাবু । ক্যামেরায় রেকর্ড করালেন পুরোটা । তারপর সই সাবুদ করে মেশিন সিল করলেন । একদম সাতটায় ভোট আরম্ভ । এসএমএস করে দিলেন, পোল স্টার্টেড । ততক্ষণে বাইরে লম্বা লাইন ।
প্রথম দু’ঘন্টায় ভোট পড়েছে ২৩৩টি । মেসেজ করে দিয়েছেন । রোদ গরম উপেক্ষা করে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিচ্ছে । ক্যামেরায় তোলা থাকছে সে ছবি । সব বেশ নিরুপদ্রব । যখন ভাবছেন, এবার ছাতু-চিনি গুলে ব্রেকফাস্টটা করে ফেললেই হয় । প্রেসারের ওষুধটাও খেতে হবে । ঠিক তখনই আবহাওয়া পরিবর্তন হতে শুরু করে ।
হঠাৎ বাইরে থেকে ঘুরে এসে গোপাল ভোটিং কম্পার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে । প্রিসাইডিং অফিসার বারণ করলেও শোনে না । বলে,
- কুন চিন্তা নাই সার, সব নিজের লোক । কেওই কেউ কিছু মনে কইরবে নাই ।
- মনে করবে না মানে ? এ’তো জুলুম । আমি এসব এলাও করবো না ।
- কেনে পাঙ্গা লিছেন সার ? আমাদের নেতা ফোন কইরেছিল । বইলে দিলেক একটাও ভোট যেন অন্য কুথাও না পড়ে । বুইতেই তো পারছেন । আমার কুন উপায় নাই ।
সামন্তবাবুকে অবাক করে সত্যিই কেউ কিছু বলে না । যেমন লাইন করে দাঁড়িয়ে ছিল, তেমনই অচঞ্চল দাঁড়িয়ে থাকে । তারপর, নিয়ম মেনে, ভোটার কার্ড দেখিয়ে, বাঁ তর্জনিতে ভোটের কালি লাগিয়ে, কালা গ’পলার চোখের সামনে ভোট দিয়ে যেতে থাকে গাঁয়ের যুবক-বৃদ্ধ-বনিতা । প্রবীণ মাস্টার মশাই হাজার চেষ্টা করেও গ’পলাদের নিরস্ত করতে পারেন না । মিছিমিছি মন-কষ্টে ভোগেন ।
এর মধ্যে একবার পাশের ঘরে গিয়ে পুলিশের সঙ্গেও কথা বলে এসেছেন তিনি । তারা জানিয়েছে, গন্ডগোল না হলে তাঁদের কিছু করার নির্দেশ নেই । ভোট তো শান্তিতেই চলছে । বুথের শান্তি বিঘ্নিত না হওয়া অবধি, ভিতরে ঢোকার পারমিশন নেই তাদের । তাছাড়া সেখানে তো ক্যামেরা রয়েছে ।
ঘোড়ার ডিম রয়েছে । ক্যামেরার ছেলেটিকে গ’পলারা কী টনিক খাইয়েছে কে জানে । ভোটের লাইন, হাতে কালি লাগানো, প্রথম ভোট দিয়ে হাসি মুখে বেরিয়ে আসা নতুন ভোটার, আকাশে মেঘ করেছে, চিল উড়ছে, ইত্যাদি সব কিছুর ছবি তুলছে । কিন্তু ‘ভোট কক্ষ’ লেখা প্লাইয়ের ঘেরা অংশের পাশেই যে একজন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তা দেখতে পাচ্ছে না ।
মাঝে একবার এসডিও এলেন । মুখ্য ভোটাধিকারিক । বুথের সামনে শান্তিপূর্ণ লাইন দেখে খুশি হলেন । ছবি নিতে বললেন ক্যামেরাম্যানকে । ভিতরে উঁকি মেরে দেখে নিলেন ভোট কেমন চলছে । তখন সব স্বাভাবিক । কোন বেনিয়ম নেই ।
সামন্তবাবু একবার ভাবলেন, এসডিওকে বলেন ব্যাপারটা । তারপর আবার, কী ভেবে, চুপ করে গেলেন । নিজের মনেই বললেন,
- ধুর, কিছু তো প্রমাণ করা যাবে না । মাঝখান থেকে ঝামেলা বাড়বে । মরুকগে যাক ।
দুপুরে ভাত, ডাল, আলু ভাজা, চিকেনের ঝোল, টমেটোর চাটনি দিয়ে জম্পেশ লাঞ্চ হল । ভোট চালু রেখেই দু’জন দু’জন করে খেতে যাওয়া । গ’পলার ব্যবস্থাপনা । পাশের একটা পাকা রুমের চাবি নাকি পাওয়া গেছে । সেখানেই বেঞ্চ-ডেস্কে বসে তৃপ্তি করে খেল সবাই । খালি সামন্তবাবু খেলেন না । ওনার শরীরটা তখন থেকেই ঠিক নেই ।
১১৪৩টা ভোট পড়েছে । প্রায় ৮৫ শতাংশ । তাতেও মন ভরে না এদের । নাকি নব্বই শতাংশ ভোট হওয়ার কথা । কথার খেলাপ হয়ে যাবে । কার যে কথা, কীভাবে তার খেলাপ হবে, তা ভগাই জানে ।
সামন্তবাবু অনেকক্ষণ থেকে রাগারাগি করছেন । কিন্তু কিছু করতে পারছেন না । শেষ দু’ঘন্টায় যা ভোট পড়ল, সবই প্রায় ফলস । পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে, শেষে, নিজেই উঠে ‘ক্লোজ’ বাটনটা টিপে দিলেন । তারপর দরজা বন্ধ করতে গিয়ে টাল খেয়ে পড়লেন ।
কাগজ পত্রের কাজ ভালোই জানেন প্রাণকৃষ্ণবাবু । সুকোমলকে নিয়ে সব সামলে নিলেন । তেওয়ারি আর নিবারণ মোমবাতি জ্বেলে গালা সিল করতে লেগেছে । সামন্ত স্যার সব গুছিয়েই রেখেছিলেন । বাকি টুকু করতে কোন অসুবিধা হল না ।
ব্যালট পেপার একাউন্ট, প্রিসাইডিং অফিসারস ডাইরি, ভোট শুরু ও শেষের ডিক্লারেশন ইত্যাদি যা যা হাতে নিয়ে যাওয়ার, সব গুছিয়ে একটা ফোল্ডারে ভরে নিলেন । ফাস্ট প্যাকেটে দেওয়ার সিল করা খামগুলো ভরে ফেললেন । এই প্যাকেটটা ডিসিআরসিতে চেক করবে । তারপর সিল । মানে গালা আর মেটাল সিলটা হাতে রাখতে হবে । বাকি আর সব প্যাকেট যেখানে যেটা ভরার ভরে সিল করে দিলেন । ভোটিং মেশিনের দুটি ইউনিট আলাদা করে সিল করলেন । তারপর সব গুটিয়ে-পাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন ।
সেখানে তখন হাল্কা হাসির একটা জটলা চলছে । প্রিসাইডিং অফিসার সামন্তবাবু তার মধ্য মনি । মাঠের মাঝে একটা হাতলওলা চেয়ারে বসে আছেন । এখন অনেকটাই সুস্থ । গোপাল ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা তাঁকে ঘিরে ধরে গল্প জুড়েছে । বেশ হাসি মজার পরিবেশ । দেখে প্রাণকৃষ্ণবাবুও আশ্বস্ত হলেন । যাক ভদ্রলোক তাহলে সেরে উঠেছেন । যা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন । তাঁদের দেখেই সামন্তবাবু হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,
- আরে প্রাণকৃষ্ণবাবু শুনুন, শুনুন । এই কালা গ’পলা কী বলছে শুনুন ।
সামন্তবাবুর মুখে ‘কালা গ’পলা’ শুনে বেশ অবাকই হলেন প্রাণকৃষ্ণ । গোপালবাবু থেকে একেবারে কালা গ’পলা ? কী এমন ঘটল যে এত পরিবর্তন ? কৌতুহলি দৃষ্টি নিয়ে, ক্লান্ত পায়ে সে দিকে এগিয়ে গেলেন সবাই । সঙ্গে সঙ্গে আরো কতকগুলো চেয়ার চলে এল । খোলা হাওয়ায় বসে বেশ আরাম লাগছে । যতক্ষণ বাস না আসে বসতে হবে । কাছেই আরো দুটো বুথের সবাইকে তুলবে । তাই বোধহয় দেরি হচ্ছে ।
সামন্তবাবু শুরু করলেন,
- এই গ’পলার অবস্থা তো আমাদের থেকেও সঙ্গীন ।
- কীরকম ?
- আরে আমি আপনি যেমন চাকরি বাঁচাতে ভোটের ডিউটিতে আসি । কালা গ’পলাও তাই । ওরও চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে ভোট না করাতে পারলে ।
- মানে ? আপনি কোথায় চাকরি করেন গোপালবাবু ?
প্রাণকৃষ্ণবাবুর প্রশ্নে রীতিমত থতমত খেয়ে যায় গোপাল । এতক্ষণ সামন্তবাবুর কথায় সেও মুচকি মুচকি হাসছিল । এবার আমতা আমতা করে, মাথা টাথা চুলকে, মুখ নিচু করে, কী যেন একটা বলার চেষ্টা করল সে । বোঝা গেল না । সামন্ত স্যারই তার হয়ে ব্যাট ধরলেন,
- আরে ধুর । এ চাকরি সে চাকরি না । এ হল গিয়ে নেতাগিরির চাকরি । বুঝলেন কিছু ?
- অ, বুঝলাম । দলের প্রার্থীকে না জেতাতে পারলে নেতা বদল হবে, এই তো ?
- ঠিক তাই ।
- এ আর এমন কী ? টিম হারলে, সর্বাগ্রে ক্যাপটেনের ঘাড়েই তো কোপ পড়ে । কি রাজনীতি, কি খেলার মাঠ । এটাই নিয়ম । আর সেই জন্যই এরা সকাল থেকে অন্য মুর্তি ধরেছিল, তাই তো ?
- অপরাধ লিবেন নাই স্যার । আমাদের পেরার্থিকে না জিতাইতে পাইরলে সব বন্ধ হইন যাবেক । বইলে দিইয়েঁছে । ইটো আমাদের রুজি-রুটির বেপার । আপনেরা বুইঝবেন নাই ।
- তা ঠিক, যার ব্যথা সেই বোঝে । কিন্তু গোপালবাবু আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন ?
- কেনে লজ্জা দিছেন আইজ্ঞা ? আপনি কি আমার শত্রু বটেন ? শুধান কী শুধাবেন ?
- সত্যি করে বলবেন কিন্তু । আমি দু’বারই লক্ষ্য করেছি । আপনাদের প্রার্থী ওই সুধাময় না কি যেন, দু’বার এসেছে আমাদের বুথে । ভোট কেমন হচ্ছে দেখতে । আর দুবারই আপনি, ঠিক সেই সময় বুথে ছিলেন না । অন্য ছেলে, ওই হারান টারানরা ছিল । ব্যাপারটা কী একটু বলবেন ?
প্রাণকৃষ্ণবাবুর কথায়, বেশ একটা রহস্যের গন্ধ পেয়ে, পোলিং পার্টির সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল । খালি কালা গ’পলা একটু যেন গুটিয়ে গেল ।
পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ভীড়ের মধ্যে থেকে হারান এগিয়ে এল এবার । বলল,
- গ’পলার সঙ্গে উয়ার কথা নাই সার । গেল বার খুব ঝাড়পিট হইয়েঁছিল । গপলা মাইরে উয়ার মুখ ফাটাইঁ দিনছিল । তেখন অবশ্য উ নীল পাটি কইরত ।
- মানে ? গতবার ও নীল পার্টি করতো । আর এবার তোমাদের পার্টির ক্যান্ডিডেট ?
- হঁ আইজ্ঞা ।
- বাঃ বেশ মজা তো । আচ্ছা এই সুধাময় তোমাদের পার্টিতে কবে এসেছে ?
- এই ধরেন তিন মাস । কি তারও কম । উ আগে বাইশ নম্বরে নীল পাটির কাউন্সেলার ছেল । ভোট ঘোষণার কিছু দিন আগে আমাদের পাটিতে ঢুকে ।
- ঢুকেই এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের টিকিট পেয়ে গেল ?
- উটোই তো সার । গ’পলার পাওয়ার কথা ছিল । পেইলেক নাই । আর ইঠিনে নীল পাটির কাউন্সেলর যে ছেল, পাঁচ বছর কুন কাম করে নাই । ইবার সতর নম্বরে যাঁইয়ে টিকিট পাঁইয়ে গেল ।
- সে তো নীল পার্টির ক্যান্ডিডেট । পেতেই পারে ।
- না সার । তবে আর বইলছি কী ? সে-ও ইবার সুধাময়ের পারা পালটি খাঁইয়েছে । আমাদের দলে নাম লিখাইছেঁ । সতর নম্বরে উয়াকে জিতাতে, আমার বা গ’পলার পারা, কেউ খাইটেছে দেখেন গে যান ।
হারানের কথা শুনে কারো মুখে আর কথা সরছে না । সামন্তবাবু, সুকোমল, নিবারণ, তেওয়ারিজি মায় প্রাণকৃষ্ণবাবুও চুপ মেরে গেছেন । বাসের হর্ণও কানে যায়নি কারুর । আধো অন্ধকারে, স্কুলবাড়ির মাঠে, ফুরফুরে হাওয়ায় গোঁজ হয়ে বসে আছেন সকলে ।
নিবারণের পাশের চেয়ারে, এতক্ষণ মাথা নীচু করে বসে থাকা, গোপালই নীরবতা ভঙ্গ করলো । পিচিক করে এক দলা থুতু নিজের পায়ের কাছে ফেলে, উঠে দাঁড়ালো সে । তারপর বলল,
- চলেন সার । আপনাদের বাস ডাঁড়াই আছে । কুন অপরাধ যদি কইরে থাকি, মার্জনা কইরে দিবেন ।
******************************
অভিজিৎ চন্দ
chandaabhijit2566@gmail.com
( Ph no. 6294012740 )
*****
ABHIJIT CHANDA,
4 – D, Sunity apartment,
Kalyanpur housing,
Asansol,
Bardhaman Poshcim,
Pin – 713305
Comments
গল্পটি কেমন লাগলো জানবার জন্য উৎসুক হয়ে আছি । দু'চার কথা লিখে দিলে ভালো লাগবে ।