অনু গল্প / মহাপ্রসাদ
মহাপ্রসাদ
=======
তিন লাফে তেতলার ছাদে উঠে এসে ছোটন রীতিমত হাঁপাচ্ছে । হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল, ঠাম্মা তোমার পাদ দিদি এসেছে । শিগগীর নিচে যাও ।
ঠাকুমার বান্ধবি পোদ্দার গিন্নীকে আমরা আড়ালে বলি, পাদ দিদা । ছোটন আমাদের মধ্যে বয়সে সব চেয়ে ছোট । বড় জোর চার কি পাঁচ । ওর অত আড়াল আবডালের বালাই নেই । সবার সামনেই বলে, পাদ দিদা । শুনে আমরা ভাই বোনেরা, মুখে হাত দিয়ে খুক খুক হাসি । ঠাম্মা একটু গম্ভীর হয়ে যান । বলেন, ''ছিঃ দাদুভাই অমন কইতে নাই'' । কিন্তু, ওই বলাই সার । কাজের কাজ কিছু হয় না ।
আজ অবশ্য ঠাম্মা সে সব কিছু বললেন না । এক মনে বিউলির ডাল বাটা ফ্যাটাতে ফ্যাটাতে বললেন, ''ওনারে গিয়া কও ছাদে আইতে । আমি বড়ি দিতে আছি তো । অহন ওঠতে পারুম না ।''
সাতষট্টি বছরের বিধবা ঠাম্মার বন্ধু ভাগ্য কিন্তু খুব ভাল । পোদ্দার দিদিই যেমন । বয়স ঠাম্মার তুলনায় বেশ কম । বড় জোর ষাট বাষট্টি । এক মাথা সিঁদুর জানান দেয় তাঁর 'সোয়ামি' বেঁচে বর্তে আছেন । এক গালে জর্দা পান ঠেসে রোজ দুপুরে আমাদের বাড়ি আসা চাই । ঠাম্মার গীতা পাঠের আসরের নিয়মিত শ্রোতা তিনি । বয়স যাই হোক, দুজনেই দুজনকে ডাকেন দিদি বলে ।গীতা পাঠ করতে করতে, কৃষ্ণ প্রেমে মাঝে মাঝে দুই বুড়ির চোখ দিয়ে জলের ধারা নামতেও দেখেছি । আজও সেই আশা নিয়েই এসেছেন নির্ঘাত । কিন্তু ঠাম্মার আজ সময় নেই ।
আগের দিন সারা রাত ভিজিয়ে রাখা বিউলির ডাল সারা সকাল ধরে মোলায়ম করে বাটা হয়েছে । আর এখন এই শীতের দুপুরে, সেই বাটা ডালের বড়ি দেওয়া হচ্ছে তিন তলার ছাদে । বড় বড় কাঁসার থালায় তেল মাখিয়ে রাখা হয়েছে । যাতে বড়ি থালার গায়ে চিটে না যায় । গোল থালায়, নধর সাদা পিরামিড আকৃতির বড়ির আলপনা দেওয়া চলছে । আর আমরা, চার থেকে দশ, সব জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাই বোনেরা, পরম বিস্ময়ে তা অবলোকন করছি ।
অবশ্য কাক চিল তাড়ানোর অতি গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব আমাদের কাঁধে । সবাই একটা করে লাঠি, তরোয়ালের মত বাগিয়ে ধরে, কাকতাড়ুয়ার ডিউটি দিতে দিতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছি । রাম রাবণ, কৌরব পান্ডব, সিরাজদৌলা ইংরেজ, কে নেই সে লড়াইয়ে । আর থেকে থেকে যাত্রা পালার ঢঙে আওয়াজ উঠছে, ''হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ !'' কাক, চিল, পায়রা, চড়ুই মায় আড়শোলাটা অবধি ধারে পাশে মাড়াচ্ছে না ।
পোদ্দার গিন্নীকে বলতে যেতে হয়নি । উনি নিজেই গুটি গুটি ছাদে উঠে এসেছেন সিঁড়ি ভেঙ্গে । বড়ি দেওয়ার কাজে হাত লাগানোর ইচ্ছেও প্রকাশ করেছেন । কিন্তু ঠাম্মা রাজি হননি । এব্যাপারে বুড়ি বড্ড খুঁতখুঁতে । বড়ি, আচার, ইত্যাদি নাকি ছোঁয়া-ছানি করতে নেই । তাই ঠাম্মার পোদ্দার দিদি হাত গুটিয়ে মাদুরের উপর বসে আছেন । আর বলে চলেছেন তাঁর সদ্য, পুরির জগন্নাথ দর্শনের গল্প । কর্তা গিন্নী সবে কালই ফিরেছেন তীর্থ দর্শন করে । তবে জগন্নাথ দর্শন করতে গিয়েও তাঁর, সইয়ের কথা খুব মনে হয়েছে । তাই আজই ছুটে এসেছেন 'দিদি'কে ভ্রমণের গল্প বলতে এবং পুরির মহা প্রসাদের ভাগ দিতে ।
লাল ইঞ্চি পাড়ের সাদা কোরা কাপড় আটপৌরে করে পরেন পোদ্দার দিদা । মাথায় ঘোমটাও দেন বড় করে । কপালে বেশ বড় সিঁদুরের টিপ । শাড়ির খুঁট খুলে মহা প্রসাদ বার করছেন দেখে আমরা, ভাই বোনেরা, খেলা ভুলে হাত পেতে দাঁড়ালাম । পুরির জগন্নাথ দেবের মহা প্রসাদ বলে কথা । নিশ্চয়ই দারুণ কিছু হবে । ঠাম্মার বড়ি দেওয়াও শেষ । হাত ঠাত ধুয়ে তিনিও দু'হাত অঞ্জলি করে দাঁড়ালেন, মহা প্রসাদ পেতে । তারপর পরম ভক্তি ভরে, প্রসাদ নিয়ে, দুই হাত মাথায় ঠেকালেন । চোখ বুজে কার উদ্দেশে জানি প্রণাম জানালেন । পড়ন্ত বিকেলের ঈষৎ লালচে আলোয় পষ্ট দেখলাম, বুড়ির চোখের কোনে জল চিক চিক করছে । তারপর পোদ্দার দিদির হাত ধরে বিড় বিড় করে বললেন, ''আপনের জন্যেই আজ আমার এই সৌভাগ্য হইল দিদি । সেই কোন কাল থিকা আমার জগন্নাথ দেবেরে দেখনের সাধ । আপনের দাদা বাঁইচ্যা থাকতে কতবার কইছি । একবার জগন্নাথ দর্শন করতে যাই ? তা তেনার সময়ই হয় না । এমনই রাজকার্য করেন । আর অখন তো তিনিই নাই । যাওনের প্রশ্নই ওঠে না । আপনি মনে কইরা আমার জন্যি মহাপ্রসাদ আনছেন । আপনের সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হউক ।''
বিষন্ন সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে, সাদা কাপড় পরা দুই বুড়ি, পরস্পরের হাত ধরে, নীরবে আরও কী কী যে বলে চলেছে, তা বোঝার বয়স আমাদের তখনো হয়নি । আমরা ভাই বোনেরা, বরং নিজের নিজের হাতের মুঠোয় ধরা দু' দানা চাল, কী করে মহা প্রসাদ হয়, সেই রহস্য সমাধানের চেষ্টায় মশগুল ।
*****
@অভিজিত চন্দ
=======
তিন লাফে তেতলার ছাদে উঠে এসে ছোটন রীতিমত হাঁপাচ্ছে । হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল, ঠাম্মা তোমার পাদ দিদি এসেছে । শিগগীর নিচে যাও ।
ঠাকুমার বান্ধবি পোদ্দার গিন্নীকে আমরা আড়ালে বলি, পাদ দিদা । ছোটন আমাদের মধ্যে বয়সে সব চেয়ে ছোট । বড় জোর চার কি পাঁচ । ওর অত আড়াল আবডালের বালাই নেই । সবার সামনেই বলে, পাদ দিদা । শুনে আমরা ভাই বোনেরা, মুখে হাত দিয়ে খুক খুক হাসি । ঠাম্মা একটু গম্ভীর হয়ে যান । বলেন, ''ছিঃ দাদুভাই অমন কইতে নাই'' । কিন্তু, ওই বলাই সার । কাজের কাজ কিছু হয় না ।
আজ অবশ্য ঠাম্মা সে সব কিছু বললেন না । এক মনে বিউলির ডাল বাটা ফ্যাটাতে ফ্যাটাতে বললেন, ''ওনারে গিয়া কও ছাদে আইতে । আমি বড়ি দিতে আছি তো । অহন ওঠতে পারুম না ।''
সাতষট্টি বছরের বিধবা ঠাম্মার বন্ধু ভাগ্য কিন্তু খুব ভাল । পোদ্দার দিদিই যেমন । বয়স ঠাম্মার তুলনায় বেশ কম । বড় জোর ষাট বাষট্টি । এক মাথা সিঁদুর জানান দেয় তাঁর 'সোয়ামি' বেঁচে বর্তে আছেন । এক গালে জর্দা পান ঠেসে রোজ দুপুরে আমাদের বাড়ি আসা চাই । ঠাম্মার গীতা পাঠের আসরের নিয়মিত শ্রোতা তিনি । বয়স যাই হোক, দুজনেই দুজনকে ডাকেন দিদি বলে ।গীতা পাঠ করতে করতে, কৃষ্ণ প্রেমে মাঝে মাঝে দুই বুড়ির চোখ দিয়ে জলের ধারা নামতেও দেখেছি । আজও সেই আশা নিয়েই এসেছেন নির্ঘাত । কিন্তু ঠাম্মার আজ সময় নেই ।
আগের দিন সারা রাত ভিজিয়ে রাখা বিউলির ডাল সারা সকাল ধরে মোলায়ম করে বাটা হয়েছে । আর এখন এই শীতের দুপুরে, সেই বাটা ডালের বড়ি দেওয়া হচ্ছে তিন তলার ছাদে । বড় বড় কাঁসার থালায় তেল মাখিয়ে রাখা হয়েছে । যাতে বড়ি থালার গায়ে চিটে না যায় । গোল থালায়, নধর সাদা পিরামিড আকৃতির বড়ির আলপনা দেওয়া চলছে । আর আমরা, চার থেকে দশ, সব জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাই বোনেরা, পরম বিস্ময়ে তা অবলোকন করছি ।
অবশ্য কাক চিল তাড়ানোর অতি গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব আমাদের কাঁধে । সবাই একটা করে লাঠি, তরোয়ালের মত বাগিয়ে ধরে, কাকতাড়ুয়ার ডিউটি দিতে দিতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছি । রাম রাবণ, কৌরব পান্ডব, সিরাজদৌলা ইংরেজ, কে নেই সে লড়াইয়ে । আর থেকে থেকে যাত্রা পালার ঢঙে আওয়াজ উঠছে, ''হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ !'' কাক, চিল, পায়রা, চড়ুই মায় আড়শোলাটা অবধি ধারে পাশে মাড়াচ্ছে না ।
পোদ্দার গিন্নীকে বলতে যেতে হয়নি । উনি নিজেই গুটি গুটি ছাদে উঠে এসেছেন সিঁড়ি ভেঙ্গে । বড়ি দেওয়ার কাজে হাত লাগানোর ইচ্ছেও প্রকাশ করেছেন । কিন্তু ঠাম্মা রাজি হননি । এব্যাপারে বুড়ি বড্ড খুঁতখুঁতে । বড়ি, আচার, ইত্যাদি নাকি ছোঁয়া-ছানি করতে নেই । তাই ঠাম্মার পোদ্দার দিদি হাত গুটিয়ে মাদুরের উপর বসে আছেন । আর বলে চলেছেন তাঁর সদ্য, পুরির জগন্নাথ দর্শনের গল্প । কর্তা গিন্নী সবে কালই ফিরেছেন তীর্থ দর্শন করে । তবে জগন্নাথ দর্শন করতে গিয়েও তাঁর, সইয়ের কথা খুব মনে হয়েছে । তাই আজই ছুটে এসেছেন 'দিদি'কে ভ্রমণের গল্প বলতে এবং পুরির মহা প্রসাদের ভাগ দিতে ।
লাল ইঞ্চি পাড়ের সাদা কোরা কাপড় আটপৌরে করে পরেন পোদ্দার দিদা । মাথায় ঘোমটাও দেন বড় করে । কপালে বেশ বড় সিঁদুরের টিপ । শাড়ির খুঁট খুলে মহা প্রসাদ বার করছেন দেখে আমরা, ভাই বোনেরা, খেলা ভুলে হাত পেতে দাঁড়ালাম । পুরির জগন্নাথ দেবের মহা প্রসাদ বলে কথা । নিশ্চয়ই দারুণ কিছু হবে । ঠাম্মার বড়ি দেওয়াও শেষ । হাত ঠাত ধুয়ে তিনিও দু'হাত অঞ্জলি করে দাঁড়ালেন, মহা প্রসাদ পেতে । তারপর পরম ভক্তি ভরে, প্রসাদ নিয়ে, দুই হাত মাথায় ঠেকালেন । চোখ বুজে কার উদ্দেশে জানি প্রণাম জানালেন । পড়ন্ত বিকেলের ঈষৎ লালচে আলোয় পষ্ট দেখলাম, বুড়ির চোখের কোনে জল চিক চিক করছে । তারপর পোদ্দার দিদির হাত ধরে বিড় বিড় করে বললেন, ''আপনের জন্যেই আজ আমার এই সৌভাগ্য হইল দিদি । সেই কোন কাল থিকা আমার জগন্নাথ দেবেরে দেখনের সাধ । আপনের দাদা বাঁইচ্যা থাকতে কতবার কইছি । একবার জগন্নাথ দর্শন করতে যাই ? তা তেনার সময়ই হয় না । এমনই রাজকার্য করেন । আর অখন তো তিনিই নাই । যাওনের প্রশ্নই ওঠে না । আপনি মনে কইরা আমার জন্যি মহাপ্রসাদ আনছেন । আপনের সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হউক ।''
বিষন্ন সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে, সাদা কাপড় পরা দুই বুড়ি, পরস্পরের হাত ধরে, নীরবে আরও কী কী যে বলে চলেছে, তা বোঝার বয়স আমাদের তখনো হয়নি । আমরা ভাই বোনেরা, বরং নিজের নিজের হাতের মুঠোয় ধরা দু' দানা চাল, কী করে মহা প্রসাদ হয়, সেই রহস্য সমাধানের চেষ্টায় মশগুল ।
*****
@অভিজিত চন্দ
Comments