পথে বিপথে / বিষ্ণুপুর
পথে বিপথে / বিষ্ণুপুর
২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে এক দিনের জন্য বিষ্ণুপুর গেছিলাম । সেদিন ছিল চৈত্র সংক্রান্তি । গাজনের মেলা । সেই কাহিনী ধারাবাহিক ছ'টি পর্বে লিখেছিলাম ফেসবুকে । এখানে সেটাই একত্রে ।
বিষ্ণুপুর টুরিস্ট
লজের বাইরেটা দেখেই ভাল লেগে গেল । বেশ বড় তিনতলা লজ । গোলাপি রং করা । সামনে
অনেকখানি ফাঁকা জায়গা, মোরাম বিছানো । বড় গেটটা দিয়ে নিশ্চিন্তে ভেতরে ঢুকে গেলাম
। কেউ বারণ করলো না । পাঁচিলের ধারে বিশাল অর্জুন গাছটার নীচে, আমার সিলভার
কালারের অল্টোটা পার্ক করলাম । তারপর ধীর পায়ে, বেশ কেতা নিয়ে এগিয়ে গেলাম রিসেপশন
কাউন্টারের দিকে ।
ছোট একটা গাড়ি
বারান্দা পেরিয়ে, রিসেপশন কাম গেস্ট লাউঞ্জ । দু’তিন জন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা
বলছে । কাউন্টারের ওপারে দুটো মাথা দেখতে পাচ্ছি । এ’পারেও জনা দুই । আমাদের
দেখেই আলোচনা থেমে গেল । কালো মতন সুবেশ এক যুবক, কাউন্টারের ওপাশে উঠে দাঁড়ালো । এক
মুখ সপ্রতিভ হাসি উপহার দিয়ে জানতে চাইল,
-- আপনাদের জন্য কী
করতে পারি স্যার ?
এত সুন্দর পরিশীলিত হাসি একমাত্র রিসেপশনের লোকজনই হাসতে পারে দেখেছি । হাসি দিয়ে অনেক কথা বলতে হয় ওদের । সেই মতো ট্রেনিং দেয়া হয় সম্ভবত ।
হাসির বহর দেখে আমার একটু সন্দেহই হল । তবু গলার স্বরে যতটা সম্ভব আভিজাত্য ফুটিয়ে বললাম,
-- দু’রাত্রির জন্য
দুটো ঘর লাগবে আমাদের । পাওয়া যাবে ?
যা আশঙ্কা করেছিলাম
তাই । দেখি, মুখের হাসি অবিকৃত রেখে দুদিকে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ছে ছেলেটা ।
-- একটাও ঘর খালি নেই
স্যার । সব ভর্তি ।
সেকি, একটাও ঘর নেই ?
এই এত বড় লজে ? অবিশ্বাসের সুর ঝরে পড়ল আমার গলায় ।
-- নেই বললে হবে কেন
? এত দূর থেকে আসছি । দু’দিন থাকবো । সঙ্গে ফ্যামিলি আছে । কিছু একটা ব্যবস্থা করুন
।
-- কোন উপায় নেই
স্যার । তিন মাস আগে থেকেই সব বুক হয়ে গেছে । এখন তো অনলাইন বুকিং হয় ।
আপনিও করতে পারেন । আজ কাল পরশু তিন দিন ছুটি আছে না ? বিষ্ণুপুরের সব হোটেলের সব
ঘর প্যাকড ।
মুখের হাসিতে হাল্কা
বিষন্নতা ফুটিয়ে এক টানা বলে গেল ছেলেটা ।
যাঃ ! এটা তো ভাবিনি
। এখন উপায় ? ছেলের পরীক্ষা শেষ হতে, কোন কিছু না ভেবে, চলে তো এলাম এদ্দুর । ওই
তিন দিনের ছুটির কল্যানেই । সঙ্গে আবার ছেলের দাদু দিদাও আছেন । সবাইকে নিয়ে আচ্ছা
বিপদে পড়া গেল দেখছি । এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই একটা না পেলে ?
করুণ সুরে বললাম,
-- আরে কিছু একটা
করুন । কোন একটা হোটেল বা লজের সন্ধান দিন । যেখানে রাতটা অন্তত থাকতে পারি । একশো
কুড়ি কিলোমিটার উজিয়ে এখন আবার ফিরে যেতে হবে নাকি আসানসোলে ?
মেকি আভিজাত্যের
মুখোশ খুলে গিয়ে, গলার সুরে কাকুতি ফুটে ওঠার জন্যই হোক । বা সঙ্গে ফ্যামিলি আছে
বলেই হোক, ছোকরার যেন একটু মায়া হোল । দলের সবাইকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বললো,
-- দেখুন, একটু এগিয়ে
। উদয়ন লজ বা হলিডেতে জায়গা পান কিনা । তবে আশা কম । অনন্তদা, একটু দেখুন তো ।
এনারা দূর থেকে এসেছেন ।
রিসেপশনিস্ট ছেলেটির
কথায় সোফায় বসা একজন উঠে এলেন আমাদের কাছে । ইনিই অনন্তদা ? দেখে মোটেই ভক্তি
হচ্ছে না । রোগা খয়াটে চেহারা । সাদা জামা । ছাই
রঙ্গা প্যান্ট । আন্ডার শুট করে পরা । তাতে আবার গোল গোল ঘামের ছোপ । কাঁধে
একটা শান্তিনিকেতনি ঝোলা । পায়ে প্ল্যাস্টিকের চটি ।
মাথার সব চুল সাদা ।
নিচের পাটির সামনের দুটি দাঁত পড়ে গেছে । মুখে হাল্কা বলি রেখার আঁকিবুঁকি । গায়ের
রং একসময় বেশ ফর্সা ছিল, বোঝা যায় । এখন রোদে ঝলসে গেছে । খুদি খুদি চোখ । অনবরত
পিটপিট করে । চাউনি ঘোলাটে । বয়স কম করে পঁয়ষট্টি । সত্তর হলেও অবাক হব না ।
এ নির্ঘাত হোটেলের
দালাল । ঘর খুঁজে দেওয়ার নামে কমিশন খাবে । এই সব পরজীবিগুলোকে এড়িয়ে চলাই শ্রেয় ।
কিন্তু এখন একটু বেকায়দায় পড়েছি, তাই... । জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অনন্তবাবুর দিকে ঘুরলাম
।
এঁর মুখে হাসি নেই
মোটে । চোখ পিটপিট করে বলে উঠলেন,
-- উদয়ন লজ কাছেই ।
কিন্তু খালি নেই । আসলে, গুড ফ্রাইডে, গাজন, পয়লা বৈশাখ, মিলিয়ে তিন দিন ছুটি তো ।
সব হোটেল বুকড । আপনাদের সঙ্গে তো গাড়ি আছে । একটু দূরে হলে আপত্তি নেই তো ?
কোথাও বেড়াতে গিয়ে
পছন্দসই হোটেল পাওয়া এক বিড়ম্বনা । হোটেল পছন্দ হলে আবার খরচে পোষায় না । জিজ্ঞেস
করলাম,
-- পছন্দ হবে তো ? কত
দূরে ?
পকেট থেকে মোবাইল ফোন
আর একটা ছোট নোটবই বার করে নম্বর লাগাতে লাগাতে লোকটা বলল,
-- বেশি দূর না ।
বড়জোর এক কিলোমিটার । লাল বাগে । জায়গাটা বেশ নিরিবিলি । ঘর পছন্দ না হওয়ার কোন
কারন নেই । দাঁড়ান একমিনিট । হ্যালো.... অনন্ত বলছি.... !
ফোন রেখে ভদ্রলোক
জানালেন, আমাদের কপাল নাকি খুব ভালো । হলিডে রিসর্টে দুটি ঘর খালি আছে । একটি ডবল
বেড আর একটি ট্রিপিল বেড । দুটিই এসি রুম । ভাড়া, ডবল বেড আটশো, ট্রিপিল বেড
বারোশো ।
শুনে চোখ কপালে ওঠার
যোগাড় । এও আবার হয় ? আমাদের তো এই রকমই চাই । ভাড়াও তো বেশ কম । লোকটা গুল দিচ্ছে
না তো ?
আমাদের আমতা আমতা ভাব
বোধহয় নজরে পড়ে থাকবে । পকেট থেকে ফস করে একটা কার্ড বের করে আমার হাতে ধরিয়ে
দিলেন ভদ্রলোক । দেখি তাতে, ছবি সহ, নাম ফোন নাম্বার ইত্যাদি
ছাপা আছে । কার্ড বলছে, সরকার স্বীকৃত গাইড তিনি । বিষ্ণুপুরের সমস্ত দ্রষ্টব্য,
টুরিস্টদের দেখানোই তাঁর পেশা ।
এরকম আরো আট জন আছেন
গোটা বিষ্ণুপুরে । যাঁদের মধ্যে তিনিই সব চেয়ে বয়স্ক । অর্থাৎ
তাঁকে অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই ।
বললাম,
-- সে না হয় বুঝলাম ।
কিন্তু হলিডে না কি বলছেন, সেখানে যাবো কী করে ? রাস্তাঘাট তো কিছু চিনি না ।
ভদ্রলোক যেন জানতেন,
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে । একটুও না ভেবে বললেন,
-- আমি আগে আগে
সাইকেল নিয়ে যাচ্ছি । আপনি একটু ধীরে আমাকে ফলো করুন । আমি শর্টকাটে নিয়ে যাবো ।
অ্যাঁ, শেষে এই ?
কিন্তু আর উপায়ই বা কী ?
অগত্যা, বাঁশ ঝাড়ের তলা দিয়ে, পুকুরের পাড় ঘেঁষে, কারুর উঠানের ধার ঘেঁষে, এঁকে বেঁকে চললো অনন্তবাবুর হিরো সাইকেল । পিছনে ফেউয়ের মতো, আমার মারুতি গাড়ি । অজানার সন্ধানে । থুড়ি, হোটেলের খোঁজে ।
সুকুমার রায়ের হযবরল
পড়া আছে নিশ্চয়ই । ওই যে,
বেড়াল বলল, “গরম লাগে
তো তিব্বত গেলেই পারো” ।
আমি বললাম, “বলা ভারি
সহজ, কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না ? কী করে যেতে হয় তুমি জানো ?”
বেড়াল একগাল হেসে
বলল, “তা আর জানি নে ? কলকেতা, ডায়মন্ড হারবার, রানাঘাট, তিব্বত । ব্যস
! সিধে রাস্তা, গেলেই হলো” ।
আসানসোল থেকে বিষ্ণুপুর
যাওয়ার রাস্তাটাও কতকটা তিব্বত যাওয়ার মত । প্রথমে এনএইচ-২ ধরে রানিগঞ্জের
পাঞ্জাবি মোড় । তারপর সেখান থেকে ১৪ নং রাজ্য সড়ক ধরে মেজিয়া, বড়জোরা, বাঁকুড়া হয়ে
সোজা বিষ্ণুপুর । গুগুল ম্যাপে আগেই দেখে নিয়েছিলাম । ইন্টারনেট আজকাল সব কিছু এত
সহজ করে দিয়েছে.... !
তবে নেট যা বলেনি, তা
জানলাম গাড়ি চালিয়ে । গোটা রাস্তাটা পুরো মাখন । আসার আগে দুয়েক জনের কাছে খবর
পেয়েছি যদিও । পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি । মনের মধ্যে ছিল পঁচিশ বছর আগের স্মৃতি । প্রথম
মোটর বাইক কিনে সেবার দু’বন্ধু মিলে বিষ্ণুপুর গেছিলাম । এই তিব্বতের রাস্তা ধরেই
। রাস্তা না বলে তাকে চষা ক্ষেত বললেই সঠিক হয় । তারপর এলাম এই এত বছর পর । আর
অবাক হলাম ।
মেজিয়া আর দুর্লভপুরের
মাঝে খানিকটা জায়গায় কাজ হচ্ছে । তাছাড়া বাকি রাস্তায় কোথাও গাড়ি একবার লাফায়নি
পর্যন্ত । চওড়া কালো রাস্তার মাঝখানে, বরাবর টানা আছে, সাদা ডিভাইডার লাইন । মোড়ে
মোড়ে সিভিক পুলিশ । গাড়ির গতি লাগাম ছাড়া না হতে পায়, সে জন্য লোকালয়ের কাছে
রাস্তার উপর রাখা, লোহার চাকাওলা রেলিং ।
মনে মনে বললাম, সাবাস
! দিদি আমাদের বকেয়া ডিএ না দিলে কী হবে ? সেই টাকায় রাস্তা-ঘাট, জল, ট্রাফিকের
হাল ফিরিয়ে দিয়েছেন । রাজ্যের কর্মচারিদের হকের টাকাতে যদিও । কিন্তু তা হোক ।
দধিচীমুনিও তো বুকের পাঁজরের হাড় খুলে দিয়েছিলেন । শুভ কাজে না হয় দধীচি হলাম ।
তাই বা কম কী ? এখন আর পশ্চিম বঙ্গকে হেলাফেলা করা যাবে না ।
ভুল ভাঙ্গল বিষ্ণুপুর
পৌঁছে । এ কী অবস্থা শহরটার ? রাস্তা কোথায় ? গাড়ি চালানো তো দূর, হাঁটা চলার
জায়গাও নেই । সাইকেল আর টোটোর দৌরাত্মে অস্থির । দুপাশের বাড়ি ঘর যেন ঝাঁপিয়ে আসছে
। কোথায় সেই পঁচিশ বছর আগে দেখা বিষ্ণুপুর ? গাছপালা ঘেরা, সুপ্রাচীন ইতিহাসে মোড়া
শহর ? ছড়ানো ছেটানো বাড়ি ঘর ? বড় বড় বৃক্ষের সারি, আর অফুরন্ত হাওয়া বাতাস ?
যেখানকার মুড়ি ফুলুরির স্বাদ আজো জিভে লেগে আছে ? চোখে ভাসছে টেরাকোটার সূক্ষ্ম
কারুকাজ । সেসব আজও অক্ষত আছে তো ? যেমনটা
দেখেছিলাম সেই সেবার ?
থাকা তো উচিৎ । অন্তত
মন্দিরগুলো তো তেমনই আছে নিশ্চয়ই । এখন তো বিষ্ণুপুর ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ
তালিকায় ঢুকে গেছে । মানে, পর্যটকদের কাছে নিশ্চয়ই আরও আকর্ষনীয় । এত বাড়ি ঘর
দোকানপাট তো সেই কথাই বলে ।
তাছাড়া
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, তখনই এখানকার সব মন্দির গুলোর রক্ষণাবেক্ষণের
দায়িত্বে ছিল, দেখেছিলাম । তারা তো আর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়নি । নিশ্চয়ই আরো উন্নত
হয়েছে ব্যবস্থা । শুধু শুধু আজে বাজে চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়া উচিৎ নয় । দেখাই যাক
না । দেখতেই তো এসেছি ।
.
হলিডে রিসর্টের
চেহারা দেখে ঘাবড়েই গেলাম । মাঠের মাঝে বিশাল এলাকা নিয়ে, সুদৃশ্য দোতলা বাংলো । এটা
হোটেল ? সামনে কেয়ারি করা বিশাল ফুলের বাগান । বাগানে পাথরের ভাস্কর্য । বড়লোকদের
বাগানবাড়িতে যেমন থাকে । বাংলা হিন্দি সিনেমায় দেখায় না ? অবিকল ওই রকম । যেন
দোতলার টেরেসে ইজি চেয়ারে বসে পাইপ খাচ্ছেন কমল মিত্র বা স্বয়ং উত্তম কুমার ।
ব্যারিটোন ভয়েসে এখুনি ভেসে আসবে, “কাকে চাই ?”
গেট দিয়ে ঢুকতেই
বাঁহাতে আম গাছের সারি । প্রচুর আম ঝুলছে । তারই মাঝে দুটি প্রমান সাইজের দোলনা ।
ডান দিকে ছোটদের ফুটবল মাঠের সাইজে খোলা প্রান্তর । ব্যাডমিন্টন, ভলি, শীতের
ক্রিকেট খেলা যায় আরামসে । তার পর স্টিলের রেলিং দেয়া সুইমিং পুল । নীল জল, সাঁতার
কাটার জন্য আদর্শ । পুলের ওই পাড়ে একটা সুন্দর দোতলা কটেজ । আর এপারে, মূল
বিল্ডিং-এর দোতলায়, সার দিয়ে ব্যালকনি । সুইমিং পুল ফেসিং । গেস্টদের থাকার আয়োজন,
ডাবল বেড, ট্রিপিল বেড রুম ।
এক তলাটা শুধুই
রিসেপশন আর ডাইনিং, কিচেন, ইত্যাদি । থাকার ব্যবস্থা সবই
দোতলায় । তাও বেশি না । মাত্র দুটো ট্রিপিল বেড
আর ছটা ডবল বেড রুম । সব ঘরেই এসি, টিভি,
ফার্নিচার, ইন্টারকম । এক কথায়, তাক লাগানো
ব্যবস্থা ।
এখানে ঘর পাওয়া যাবে
? নিশ্চয়ই ভাড়া বেশি । আমাদের বাজেটের বাইরে । না পোষালে থাকব না । তবে মানতেই হবে
হোটেলটা দারুণ । জায়গাটাও ।
সুসজ্জিত রিসেপশনের
সোফায় বসে অনন্তবাবু রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছেন । এতটা পথ সাইকেল চালিয়ে এসেছেন । কত
টাকা কমিশন দিতে হবে কে জানে ।
ম্যানেজার মিস্টার
মুখার্জির হাসিটাও রিসেপশনিস্ট মার্কা । বললেন,
-- অনন্তদার সঙ্গে তো
আগেই কথা হয়েছে । একটা ডবল আর একটা ট্রিপল বেড খালি আছে । তাও আজকের জন্য । ঘর দেখে
নিন ।
জিজ্ঞেস করলাম,
-- ভাড়া কত ?
একটা ছোট ভিজিটিং
কার্ড বাড়িয়ে দিলেন । যার এক দিকে লজের নাম, ফোন নম্বর ইত্যাদি । উল্টো পিঠে রুম
ট্যারিফ । এসি ডবল বেড ৮০০ টাকা । ট্রিপল বেড ১২০০ টাকা । কটেজ ২৫০০ টাকা ।
.
ঘড়ি বলছে, বেলা দেড়টা
বাজে । পেট বলছে, দমে ভুখ লাগিছে । তবে তার আগে, জমিয়ে চান করতে হবে । যা গরম ! রুমে
যাওয়ার আগে অনন্তবাবুকে বিদায় করি ।
গিন্নী কানে কানে বলে গেল,
-- ভদ্রলোক খুব
করেছেন আমাদের জন্য । যা চায় দিয়ে দাও । বুড়ো মানুষ ।
আমিও মনে মনে তাই
ভাবছি । লোকটা বাজে কথা বলেনি একটাও । এই ভাড়ায় এই ঘর কল্পনা করা যায় না । বললাম,
-- আপনাকে কত দিতে
হবে অনন্তবাবু ?
আমাকে অবাক করে দিয়ে
ভদ্রলোক বললেন,
-- এখন তো আমাকে কিছু
দেয়ার নেই । যদি বিকেলে মন্দির দেখতে যান, তবে আমি গাইড হতে পারি । সরকারি
লাইসেন্স আছে আমার, গাইড হিসাবে । বিষ্ণুপুরের ইতিহাস ও মন্দিরের বিশেষত্ব অনেক
কিছু জানার আছে । যদি জানতে চান, তো বলুন । সাড়ে তিনটেয়
টোটো নিয়ে আসব । সব মন্দির গুলো ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব । সেগুলির ইতিহাস বলবো । দু
থেকে আড়াই ঘন্টা লাগবে । তখন দেবেন । সাড়ে তিনশো টাকা । ওটাই আমাদের রেট ।
বলতে যাচ্ছিলাম,
বিষ্ণুপুরের কটা ইঁটের মন্দির দেখার জন্য আবার গাইড ? ও তো নিজেরাই দেখে নেওয়া যায়
। এর আবার বিশেষত্ব কী ?
কিন্তু বলতে গিয়েও
বললাম না । বুড়ো মানুষটিকে কিছু দেয়া হবে না তাহলে । লোকটা আমাদের জন্য খুব খেটেছে
।
একটু ভেবে বললাম,
-- বেশ তাই হোক ।
আনুন টোটো । আমরা খেয়েদেয়ে রেডি হয়ে নিচ্ছি ।
.
দুপুরের খাওয়াটা জবর
হয়েছে । রিসর্টের ঠাকুরের (নাকি শেফ হবে) রান্নার হাত বেশ ভালো । আমরা ভয়ে ভয়ে
সিম্পিল মাছ ভাত বলেছিলাম । আর ডাল, আলু পোস্ত, ঝিরি ঝিরি আলু ভাজা । কী জানি
রান্না কেমন হবে !
ওই পাতলা করে কাটা
কড়কড়ে আলু ভাজাটা আমার ছেলের খুব প্রিয় । ও ওটার নাম দিয়েছে সেলু । সেউ আর আলুর
সন্ধি আরকি । আমিও সেলু ভাজা ভালবাসি । তবে বাঁকুড়া বিষ্ণুপুরের আলু পোস্তর চেয়ে
কম । কলাইয়ের ডাল আর উপর থেকে কাঁচা তেল ছড়ানো আলু
পোস্ত । আহা, ডেডলি কম্বিনেশন । সঙ্গে যদি কাঁচা
পেঁয়াজ আর কাঁচা লংকা থাকে । আর কী চাই ?
আজকাল সব নেমন্তন্ন
বাড়িতেই দেখি, মেইন কোর্স মানে মাছ বা মাংসর আগে, হয় কাশ্মিরি আলুদম নয় মিক্স ভেজ
থাকে । পনীরের টুকরো দেয়া ওই চোদ্দমিশালিটা
আমার অখাদ্য লাগে । আলুরদম তো ভাতের সঙ্গে খাওয়ার পদই নয় । কেন
রে বাবা ? এই রকম বেশি বেশি পোস্ত বাটা দিয়ে সাদা সাদা আলু পোস্ত করা যায় না ?
দেবভোগ্য এই আলু
পোস্ত খাওয়ার জন্যই বার বার বিষ্ণুপুর আসা যায় ।
আমার গিন্নী তো রাতেও আলু পোস্ত ভাত খাবে ঘোষণা করে দিল । তা ভাল । খরচ কিছুটা
বাঁচবে । খাবারের যা দাম এখানে । ঘর ভাড়া কম রেখে, খাবারে পুষিয়ে নিচ্ছে । পলিসি
মন্দ নয় । তবে খাবারের কোয়ালিটি বেশ ভালো । দাম গায়ে লাগবে না ।
.
কথা মত, ঠিক সওয়া
তিনটেয় অনন্ত বাবু এসে হাজির । আমরাও সবাই রেডি । সাড়ে তিনটেয় বেরোনোর কথা ।
কিন্তু টোটো কই ? কথা ছিল উনিই দুটো সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন । বিষ্ণুপুরের রাস্তায়
টোটো চেপে টো টো করাই নাকি সুবিধাজনক । আগে যখন এসেছিলাম, পঁচিশ বছর আগে, খালি
রিক্সা দেখেছিলাম । এখন সে জায়গা নিয়েছে ব্যাটারি চালিত টোটো । কিন্তু কোথায় সে ?
অনন্তবাবু জানালেন,
টোটো পাওয়া যাচ্ছে না । গাজনের মেলা লেগেছে তো । সব
ওখানে ভিড় করেছে । অগত্যা... আবার সকালের মতন । আগে
আগে সাইকেল চলে, পিছে চলে অল্টো ।
ওঃ ! বিষ্ণুপুরের গলি
ঘুঁজিতে গাড়ি চালানো ? হরিবল । ড্রাইভিং টেস্ট ভালোই হচ্ছে । হরি
বোল ! হরি বোল ! জয় নিতাই ! রাধে-গোবিন্দ !
.
হরির নাম জপতে জপতে
গাড়ি চালাচ্ছি । গলির গলি তস্য গলি ভেদ করে । আগে আগে চলেছেন
আমাদের পথ প্রদর্শক কাম গাইড । অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় । তাঁর হিরো সাইকেলে । আমাকে
স্ট্রিকটলি বলে দিয়েছেন তাঁকে ফলো করতে । মাঝে মাঝে পিছনে না ফিরেই, হাতের সিগনালে
বলে দিচ্ছেন কোন দিকে বেঁকতে হবে । আমিও বাধ্য ছাত্রর মত, ওনার নির্দেশ অক্ষরে
অক্ষরে মেনে গাড়ি চালাচ্ছি । ফাস্ট গিয়ারেই বেশি । ক্বচিত কখনো সেকেন্ড গিয়ার ।
রাস্তায় ভিড় আছে
ভালোই । গাজনের ভিড় । তবে দোকান পাট বেশিরভাগই বন্ধ । সব নাকি মেলা দেখতে চলেছে ।
পাশ দিয়ে সাঁ করে, ভাঁজ মেরে ওভারটেক করে যাচ্ছে সাইকেল । সেগুলোর সওয়ারি অল্প
বয়সি হিরোরা । দুয়েক জন হিরোইনও আছে । এখানে সবাই সাইকেল চালায় । ছেলে মেয়ে মানা
মানি নেই । ভালোই লাগে দেখতে ।
হঠাৎ, হাতের সিগনালে
রাস্তার বাঁদিকে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন অনন্ত বাবু । নিজেও দাঁড়িয়ে গেছেন সাইকেল
স্ট্যান্ড করে । গাড়ি থেকে নামতেই বললেন,
-- ওই দেখুন । এই হল
রাসমঞ্চ । রাধা-কৃষ্ণের লীলা মন্দির । মল্ল রাজাদের আমলে রাস উৎসব হত এখানে ।
শহরের সমস্ত মন্দিরের যাবতীয় রাধাকৃষ্ণের মূর্তি, রাসের সময় এখানে নিয়ে আসা হত ।
বিষ্ণুপুরের সব চেয়ে পুরনো মন্দির এটি । মল্লরাজ বীর হাম্বির এটি বানিয়েছিলেন । আজ
থেকে চারশো সতের বছর আগে । ১৬০০ খৃষ্টাব্দে । তাজ মহলেরও পঞ্চাশ বছর আগে ।
সম্পুর্ণ পোড়া ইঁটের তৈরি এমন আশ্চর্য্য স্থাপত্য কর্ম সারা পৃথিবীতে আর নেই ।
বিষ্ণুপুরের মানুষ
হিসেবে নিজের শহরের প্রতি অতিরিক্ত আবেগ থাকা স্বাভাবিক । ভাবলাম সেই আবেগের বশেই,
কিঞ্চিত বাড়িয়ে বলছেন বৃদ্ধ । নইলে টেরাকোটার মন্দির দেখাতে গিয়ে কেউ তাজমহলের
প্রসঙ্গ টানে ? ঈষৎ তাচ্ছিল্য মিশিয়েই প্রশ্ন করলাম,
-- তাই নাকি ? তা, কী
এমন বিশেষত্ব আছে এই মন্দিরের ?
খোঁচাটা বোধহয় একটু
বেশি হয়ে থাকবে । মুখটা কিঞ্চিৎ গম্ভীর হয়ে গেল । দু’তিন মুহূর্ত চুপ । তারপর চোখ
পিটপিট করে বললেন,
-- বোঝবো । তার আগে
চটপট সবার টিকিটটা কেটে ফেলুন । আমার জন্যও একটা নেবেন । এই এক টিকিটে সব মন্দির
দেখা হয়ে যাবে । তাই টিকিটটা দেখিয়ে আবার সঙ্গে রেখে দেবেন । ফেলে দেবেন না ।
ভাবলাম, এ তো আচ্ছা
নিয়ম ! একই টিকিটে সব মন্দির দেখা যাবে ? তাহলে নিশ্চয়ই অনেক দাম টিকিটের । আবার
সরকারি গাইডেরও টিকিট লাগে ? যাকগে, যস্মিন দেশে যদাচার । ছোট্ট টিকিট কাউন্টারের
ঘুপচি জানালায় মুখ বাড়িয়ে বললাম,
-- ছটা টিকিট দিন ।
কত লাগবে ?
-- নব্বই টাকা ।
-- মানে মোট পাঁচশো
চল্লিশ টাকা ?
-- না । পার হেড
পনেরো টাকা । মোট নব্বই টাকা ।
অ্যাঁ, বলে কী ?
মাত্র পনেরো ? এত কম টাকায় এতগুলো মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে যায় ? প্রতিদিন কত
হাজার দর্শনার্থী হয় এখানে ? এই মুহূর্তে তো ফাঁকাই । আমরা ছাড়া আর জনা সাত-আট
পর্যটক দেখতে পাচ্ছি । খুব একটা ভিড় হয় বলে তো মনে হচ্ছে না । তাহলে নিশ্চয়ই
সরকারি অনুদান আছে । ভাবতে ভাবতে উঠে পড়লাম রাসমঞ্চের বেদিতে ।
চূণ সুড়কি ইঁটের তৈরি
প্রাচীন মন্দিরের গায়ে ছলকে পড়ছে বিকেলের সোনা রোদ । লালচে কাঠামোর উপর সোনালি আভা
খেলে যাচ্ছে । রাস লীলার জন্য বানানো, খিলানগুলোর ফাঁক
দিয়ে আসা, সেই আলো পড়ে স্বর্ণচরি শাড়ির কারুকাজ সৃষ্টি হয়েছে । মোহময় সে রূপ । চোখ
ফেরানো যায় না । দেখতে দেখতে মন চলে যায় কোন সুদূরে । হঠাৎ ছেলের প্রশ্নে সম্বিত
ফিরে পেলাম । মনের সুখে ছবি তুলতে তুলতে সে বলল,
-- বাবা দেখ,
মন্দিরের মাথাটা যেন পিরামিডের মত ! তাই না ?
মাত্র কদিন আগেই তার
এক বন্ধু ইজিপ্ট বেড়িয়ে ফিরেছে । মিশরের পিরামিডের ছবি দেখেছে সে বন্ধুর কাছে । ওর
কথা শুনে রাসমঞ্চের মাথায় তাকাই । সত্যিই তো । যেন একটা ইঁটের পিরামিড বসানো আছে
মন্দিরের মাথায় ।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে
অনন্তবাবুর দিকে ফিরে দেখি, বৃদ্ধ মুচকি মুচকি হাসছেন । মানে এতক্ষণ আমাদের সব কথা
শুনেছেন । কিন্তু কিছু বলেননি । বোধহয় অভিমানে । এবার মুখ খুললেন,
-- আপনার ছেলে ঠিকই
বলেছে । ওটা পিরামিড । একদম মিশরের স্থাপত্য । যেভাবে ইজিপ্টের পিরামিড তৈরি হয়েছে
হাজার হাজার বছর আগে, ঠিক সেই পদ্ধতিতেই ওই ইঁটের পিরামিড তৈরি হয়েছে এই রাসমঞ্চের
মাথায় । তফাৎ খালি ওগুলো পাথরের আর এটা ইঁটের । ওগুলো বালির উপরে দাঁড়িয়ে । আর এখানে
আস্ত পিরামিডটা দাঁড়িয়ে আছে ছত্রিশটা থামের আর্চের উপরে । সমস্ত ওজনটা ওই থামগুলোর
উপরে সমানভাবে ডিস্ট্রিবিউট হয়েছে । দেখে নিন । আশ্চর্য্য কারিগরি । সারা পৃথিবীতে
এই অদ্ভুত আর্কিটেকচার আর দুটো নেই । মুসলিম স্থাপত্য, হিন্দু মন্দির শৈলী এবং
মিশরিয় ডিজাইনের এমন অসাধারণ মিশেল বিষ্ণুপুর ছাড়া কোথাও পাবেন না ।
.
রাসমঞ্চের প্রশস্ত
বেদিতে উঠে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি টেরাকোটার কারুকাজ । মন্দিরের স্থাপত্য ।
কেউ বাধা দেয়ার নেই । মনে হচ্ছে, ইতিহাস যেন কথা বলে উঠবে এখুনি । গাইড অনন্তবাবু বলে
চলেছেন,
-- বিষ্ণুপুর তথা
মল্লভূমির ইতিহাস প্রায় দেড়হাজার বছরের পুরনো । ৬৯৪ খৃষ্টাব্দে, আদি মল্ল রঘুনাথ,
প্রথম মল্লরাজা হয়ে সিংহাসনে বসেন । তাঁর পিতা নৃসিংহ
দেব ছিলেন রাজপুত বীর । সুদুর রাজস্থান থেকে তাঁর বশধররা এই রাঢ় বাংলায়
কী করে এলেন তাই নিয়ে দ্বিমত আছে ।
শোনা যায়, খুব ছোট
বেলায় রঘুনাথের পিতার মৃত্যু হয় । সম্ভবত রাজ্য জয় করতে এসে প্রাণ হারান তিনি । স্ত্রী
সন্তান সেই থেকে এখানেই রয়ে যান ।
আবার কোন কোন
ঐতিহাসিকের মতে, রঘুনাথের পিতা, সন্তান সম্ভবা স্ত্রী কে নিয়ে এই পথ দিয়ে পুরী
যাচ্ছিলেন । জগন্নাথ দর্শনে । সেই সময় স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠলে তাকে এই জঙ্গলের
আদিবাসীদের কাছে রেখে চলে যান । আর ফিরে আসেননি ।
-- বলেন কী ? ৬৯৪
খৃষ্টাব্দ ? তখন তো অযোধ্যায় শ্রী রামচন্দ্র রাজা ছিলেন, তাই না ? লংকা বিজয় তখনও
হয়নি বোধহয় ?
আমার রসিকতাকে মোটে
পাত্তা না দিয়ে বৃদ্ধ বলে চলেছেন,
-- বালক রঘুনাথ এই
অঞ্চলের আদিবাসী বাগদীদের কাছে মানুষ হন । বড় হয়ে তার শরীরের ক্ষত্রিয় রক্ত তাকে দলপতি হতে
সাহায্য করে । পরে এই আদিবাসী বাগদিদেরই সাহায্যে তিনি
স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন । নাম দেন, মল্লভূম । বাগদীদের নেতা ছিলেন বলে কেউ কেউ
তাকে বাগদীরাজাও বলেন ।
এই অবধি শুনে আমি বললাম,
-- হ্যাঁ, এই তথ্য
আমিও শুনেছি । গরিব আদিবাসীদের নিয়ে আদি মল্ল এক
অপরাজেয় বাহিনী গড়েছিলেন । আদিবাসীরা বাগদি রাজাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত । যুদ্ধ
বিদ্যায়ও তারা বিশেষ পটু ছিল । তাই বাগদি রাজাকে কেউ বিশেষ ঘাঁটাতে সাহস পেত না ।
আমার প্রশংসা সূচক
টিপ্পনিতে এত ক্ষণে বৃদ্ধের মুখে একটু হাসির ঝিলিক দেখলাম । বললেন,
-- মল্ল মানে যোদ্ধা
। মল্ল যোদ্ধা । মল্ল রাজারা যুদ্ধ বিদ্যায় পটু ছিলেন । দীর্ঘ দেড় হাজার বছর
রাজত্ব করা মুখের কথা নয় । মারাঠা বর্গিরাও এই মল্লভূমি থেকে মার খেয়ে ফিরেছে ।
কারণ এরা কামানের ব্যবহার জানত । দলমাদল তার প্রমাণ ।
আবার শিক্ষা ও সংস্কৃতি
চর্চাতেও মল্লভূম পিছিয়ে ছিল না । রাজারা সঙ্গীত, শিল্পকলা, হস্তশিল্পর পৃষ্ঠপোষক
ছিলেন । বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীত তো সারা বিশ্বে সমাদৃত । বালুচরি শাড়ি, টেরাকোটার
ঘোড়াকেও সবাই এক ডাকে চেনে ।
আদি মল্ল রঘুনাথ,
নিজের রাজ্যাভিষেকের দিন থেকে একটি বার্ষিক ক্যালেন্ডার চালু করেন । নাম দেন
মল্লাব্দ । খৃষ্টাব্দের চাইতে ৬৯৪ এবং বঙ্গাব্দর চাইতে মাত্র ১০১ বছরের ছোট এই
মল্লাব্দ । যা আজো চালু আছে এই মল্লভূমিতে ।
একটুও না থেমে, গড় গড়
করে, বিষ্ণুপুরের ইতিহাস বলে চলেছেন অনন্তবাবু । শ্রোতা আমরা পাঁচ জন । হাঁ করে
শুনছি ।
অনেক ক্ষণ একটানা বলে
একটু থামলেন বৃদ্ধ । ঝোলা থেকে একটা জলের বোতল বার করে গলায় ঢাললেন । গরম ভালোই
পড়েছে । রোদের তেজ এখনো কমেনি । অথচ রাসমঞ্চের খিলানগুলোর মধ্যে দিয়ে শীতল হাওয়া
বইছে । রোদে ইঁটের দেয়াল বা ছাদ খুব একটা গরম হয় না ।
ক্ষুদে ক্ষুদে পাতলা
পাতলা ইঁটের খিলান, বাঁকানো ছাদ, গোল থাম দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, কোন আর্কিটেক্ট এর
ডিজাইন করেছে ? আর ওই বাঁকানো চালাগুলোর উপর আস্ত পিরামিড বসানোর বুদ্ধিটাই বা কার
?
বর্গাকৃতি মন্দিরে এখন
আর কোন বিগ্রহ নেই । এক সময় ছিল । রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তি
। গর্ভগৃহ আছে । তবে তালা বন্ধ । গর্ভগৃহের মাথার উপরেই রয়েছে সেই লাল ইঁটের
পিরামিড । খাঁটি মিশরীয় স্থাপত্যর নিদর্শন ।
অনন্তবাবুকে এই নিয়ে
প্রশ্ন করবো ভাবছি । বৃদ্ধ নিজেই মুখ খুললেন,
-- আসলে, কী জানেন ?
আমাদের ইতিহাস বইয়ে মল্ল রাজাদের সম্পর্কে খুব একটা বেশি কিছু বলা নেই । ওই বড়জোর
হাম্বিরের নাম আছে একটু আধটু । তাও তিনি বীর যোদ্ধা ছিলেন বলেই । আর কিছুটা এই রাসমঞ্চ,
দলমাদল কামান তৈরি করিয়েছিলেন বলে । টেরাকোটার মন্দির গড়েছিলেন বলে । অথচ, বিদেশী
গবেষকরা এসে এখানকার বিষয়ে গবেষণা করে । ছবি তুলে নিয়ে যায় । আমাদের নিজেদের
জিনিসের কদর আমরাই করি না ।
সদ্য ক্লাস টেনের পরীক্ষা দেওয়া আমার ছেলে পাশ থেকে বলে উঠল,
-- রাজা হাম্বির তো
মল্ল ডায়নেস্টির ফরটিনাইন্থ রাজা ছিলেন তাই না ? সম্রাট আকবরের বন্ধু ?
আমার ইতিহাস জ্ঞান
খুবই করুণ । ওই সন তারিখের ব্যাপার স্যাপার কোন দিনই
আমার মাথায় ঢোকে না । ছেলের কথায় ওর দিকে ফিরলাম । খানিকটা প্রশংসা মেশানো স্বরে
জানতে চাইলাম,
-- আকবরের বন্ধু ?
মানে মুঘল সম্রাট আকবর ? তাই নাকি ?
-- একদম ঠিক বলেছো ।
বাবু তুমি কোন ক্লাসে পড় ?
পুত্র গর্বে গর্বিত
পিতা আমি । ছেলে কিছু বলার আগেই বলে উঠলাম,
-- এই তো ক্লাস টেন
সিবিএসই দিল । তোদের সিলেবাসে ছিল হাম্বিরের কথা ? আমরা তো যখন ছোট ছিলাম,
মল্লভূমের নামটুকুই শুনেছিলাম । রাজা হাম্বিরের নাম শুনি অনেক পরে রবীন্দ্রনাথের
একটা কবিতায় ।
আমার মুখের কথা কেড়ে
নিয়ে অনন্তবাবু আবার শুরু করলেন,
-- ওইটাই তো হয়েছে
মুশকিল । আপনি একটু আগে জিজ্ঞেস করছিলেন না, তখন রাম রাজা ছিলেন কিনা ? ঘটনা হল,
পৌরানিক চরিত্র রামচন্দ্র না হলেও, তখন দিল্লি তথা উত্তর ভারতের সর্বত্র হিন্দুরাই
রাজত্ব করতেন । মুসলমান রাজা তো দূর, মুসলিম ধর্মের নামও তখন কেউ শোনেনি ভারত
ভূখন্ডে । আর্য ক্ষত্রিয়রাই তখন বিস্তীর্ণ নদী অববাহিকার শাষণ কর্তা । ও দিকে
দাক্ষিণাত্যের অনার্য রাজাদের কথাও শোনা যায় । কিন্তু এই জঙ্গুলে রাঢ় ভূমিতে,
আদিবাসীদের নিয়ে দীর্ঘকাল রাজত্ব করে চলা মল্ল রাজাদের কথা, কোন ঐতিহাসিকও সেভাবে
বলেননি । যেন, এই রুখু সুখু পাথুরে জমিতে, জঙ্গলি
আদিবাসীদের জীবন সম্পর্কে আবার জানার কী আছে ? ইদানিং বিদেশীরা এখানকার ইতিহাস
নিয়ে ঘাঁটা ঘাঁটি করতে আমাদের টনক নড়েছে ।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে
গেছি । আদিবাসী সম্প্রদায় ‘মাল’দের বাসস্থান ছিল এই অঞ্চল । কেউ কেউ মল্লভূমি
নামের কারণ হিসেবে এটাকেও চিহ্নিত করেন ।
.
বুড়ো ভদ্রলোকের
পড়াশোনার বহর দেখে ততক্ষণে আমরা, বাস্তবিকই হাঁ হয়ে গেছি । বেশ বুঝতে পারছি, আরো
কিছু চমকপ্রদ ইতিহাস বেরোতে পারে তাঁর ঝোলা থেকে । বিষ্ণুপুরের মাটিতে জন্মেছেন
বলে রীতিমত গর্বিত মনে হল । আবার খোঁচা দেওয়ার মত করে বললাম,
-- তা তো বুঝলাম ।
কিন্তু, ওই সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ব্যপারটা ঠিক বুঝলাম না । এখানকার রাজাদের কি
নিজেদের কোন ধর্মই ছিল না ?
খানিক ক্ষণ আমার
মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ পিট পিট করলেন ভদ্রলোক । কী বুঝলেন কে জানে । তারপর বললেন,
-- সব বলবো । তার আগে
চলুন শামরায় মন্দিরটা দেখে নিই । অন্ধকার হয়ে গেলে মুশকিল । ইদানিং এই সব মন্দিরে
আলোর ব্যবস্থা নেই । সন্ধ্যা নেমে গেলে আর কিছুই দেখা যাবে না ।
-- বলেন কী আলো নেই ?
কেন ? আমি তো বহু বছর আগে এসেও আলো জ্বলতে দেখেছি ।
-- ঠিকই । গত এক বছর
হল সব বন্ধ হয়ে গেছে । কেন, বলতে পারবো না ।
চলুন, আমাকে ফলো করুন । পরের দ্রষ্টব্য শামরায় ।
শ্যামরায় মন্দিরের
টেরাকোটার কাজ সব চেয়ে সূক্ষ্ম । একেবারে মিহিন কাজ । পোড়া মাটি দিয়ে যে এত নিখুঁত
কাজ করা যায়, না দেখলে বিশ্বাস হয় না । বিরানব্বই সালে যখন এসেছিলাম, এই মন্দিরের সারা
গায়ে বাঁশের মাচা লাগানো ছিল । শুনেছিলাম, ভারত সরকারের পুরাতত্ব বিভাগ মন্দিরের
মেরামত করছে । তাই ভালো করে দেখতে পাইনি ।
এবার কোন উপদ্রব নেই
। একদম কাছ থেকে, হাত বুলিয়ে দেখলাম পোড়া মাটির অপূর্ব কারুকাজ । কোথাও রামায়ণের
বালি সুগ্রিবের লড়াই, কোথাও মহাভারতের যুদ্ধ আবার কোথাও গোপিনীদের সঙ্গে রাস লীলায়
মেতেছেন স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণ । কোথাও বা শুধুই নকশা । বালুচরি শাড়ির মত ।
অনন্তবাবু জানালেন,
-- ১৬৪৩ খৃষ্টাব্দে
এই মন্দিরটি তৈরি করেন রাজা রঘুনাথ সিংহ । বিষ্ণুপুরের নিজস্ব ঘরানার টেরা কোটা এই
মন্দিরের বিশেষত্ব । গোটা মন্দিরের গা ঢেকে আছে বিভিন্ন সাইজের টেরাকোটার পেলেটে ।
অথচ, কোন পেলেট দুবার ব্যবহৃত হয়নি । মানে সব কটি ছাঁচ মাত্র একবার ব্যবহার করে
নষ্ট করে ফেলা হয়েছে ।
অবাক হয়ে প্রশ্ন
করলাম,
-- ছাঁচ ? এর মধ্যে
আবার ছাঁচ আসছে কোথা থেকে ? কাদা মাটির মুর্তি বা কারুকাজ ওয়ালা পেলেট, যাই বানানো
হোক না কেন, আগুনে পুড়িয়ে দিলেই তো হোল ।
আমার অজ্ঞতায় মলিন
হাসলেন বৃদ্ধ । বললেন,
-- ওই তো ! আমাদের
ধারণা হচ্ছে, পোড়া মাটি আর এমন কী ? খানিক কাদা মেখে, কিছু গড়ে, আগুনে পুড়িয়ে
নিলেই হোল । আর এই একই কাজ যখন চিন জাপান করে তখন সেটা হয়ে যায় বোন চায়না । তখন
তার কদরই আলাদা । জানেন, এখন এই টেরাকোটার কাপ প্লেটও তৈরি হচ্ছে এখানে ? একদম বোন
চায়নাকে টেক্কা দেয়া ? পেয়ে যাবেন দলমাদলের সামনে । কিনে নেবেন ।
আর জেনে রাখুন, এই
টেরাকোটা শিল্পটা অত সহজ নয় । স্পেশাল মাটি আছে । যা শুধু বিশেষ বিশেষ জায়গাতেই
মেলে । তার হদিশ জানা চাই । চিনতে পারা চাই । তারপর সেই মাটিকে বিভিন্ন উপকরণ
মিলিয়ে তৈরি করতে হয় । এমনভাবে, যেন তা দিয়ে যে কোন কারুকাজ করা যায় । অথচ শুকিয়ে
গেলে চিড় ধরে না । অথবা বেঁকে যায় না । তারপর আছে পোড়ানো । এবং সেখানেও
টেম্পারেচারের ব্যাপার । পুরো দস্তুর ইঞ্জিনিয়ারিং । আপনারা শুধু এর কারুকাজটাই
দেখছেন । পিছনের টেকনলজিটা দেখছেন না ?
সূক্ষ্ম কাজের জন্য ছাঁচ লাগে বইকি । আরো কী কী লাগে সব জানতে হলে, কাল সকালে চলে যান না । বেশি দূরে নয় । কাছেই পাঁচ মুড়া বলে একটা গ্রাম আছে । টেরাকোটা গ্রাম বলেই বিখ্যাত । ওই গ্রামে সবাই এই কাজ করে । বিষ্ণুপুরের ঘোড়াও কিনে নিয়ে যেতে পারেন ওখান থেকে ।
অনন্তবাবুর কথায় মনে
পড়ে গেল, পঁচিশ বছর আগের কথা । বাইক নিয়ে দুই বন্ধু সেবার ঢুঁ মেরেছিলাম ওই গ্রামে
। বিশাল বিশাল পোড়া মাটির ঘোড়া তৈরি হতে দেখেছিলাম নিজের চোখে । দেশীয় ফার্নেসে
কীভাবে আগুনে পুড়ে লাল হচ্ছে মাটির পুতুল, দেখে অবাক হয়েছিলাম ।
ভাবলাম বলি সে অভিজ্ঞতার
কথা । তারপর আবার বললাম না । কী জানি ভদ্রলোক আবার কীভাবে নেন । এমনিতেই কয়েক বার
ফাউল করে ফেলেছি । বার দুয়েক জেনে, বারদুয়েক না জেনে । শুধু বললাম,
-- কাল কি আর সময় হবে
? মনে হয় না । পাঁচমুড়া এবার থাক । পরে কখনো দেখা যাবে ।
-- পাঁচমুড়া গ্রাম না
দেখুন, পাঁচমুড়া মন্দিরটা তো দেখুন । এই শামরায় মন্দিরের পাঁচটা চুড়া দেখতে
পাচ্ছেন ? এই জন্য একে আমরা, বিষ্ণুপুরের লোক, পঞ্চরত্ন বা পাঁচমুড়া মন্দির বলি ।
মাঝের চুড়াটা লক্ষ্য করুন । অষ্টভুজাকৃতি গম্বুজ । ইংরেজ স্থাপত্যর সঙ্গে মিল
পাচ্ছেন না ? মনে হচ্ছে না প্রাচীন কোন গির্জা ? ভালো করে ওপর দিকটা তাকিয়ে দেখুন
।
বৃদ্ধর কথা মত শুধু
ছাদের দিকে তাকালাম । সত্যিই তো ! কতকটা যেন ইংরেজ গির্জার আদল । বললাম,
-- কিন্তু, আপনার কথা
যদি সত্যি হয়, তাহলে এই মন্দির তৈরি হয়েছে পলাশির যুদ্ধেরও একশো বছর আগে । তাহলে
ইংরেজ স্থাপত্যর প্রভাব এখানে এল কীভাবে ?
আমার প্রশ্নটা যে
এইদিকে মোড় নেবে, যেন আগে থেকেই জানতেন ভদ্রলোক । দেখি মিটি মিটি হাসছেন । হাসতে
হাসতেই বললেন,
-- তার মানে কি বলতে
চান, রাসমঞ্চের মাথার পিরামিডটা মিশরের ফারাওরা এসে বানিয়ে গেছিলেন ?
আক্রমণটা যে এভাবে
আসতে পারে কল্পনাও করিনি । মুখে একটা বোকা হাসি ফুটিয়ে কোনক্রমে সামাল দেওয়ার
চেষ্টা করলাম,
-- না, তা নয় । তবে, শিল্পরীতি
প্রভাবিত হওয়ার তো একটা ভিত্তি থাকবে ।
-- তা তো আছেই ।
সেটাই তো আপনাদের দেখাতে চাইছি । আর তা হোল শিক্ষা । তা হোল সংস্কৃতি । তা হোল
বসুধৈব কুটুম্বকম । আর্য, অনার্য,
দ্রাবিড়ীয়, হিন্দু, মুসলিম, ক্রিশ্চান, ইজিপশিয়ান সমস্ত ধারার সংমিশ্রণ ঘটেছে এই
মল্লভূমিতে । এর শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, সমাজ জীবনে ।
কি জানেন, অর্থ বা
সম্পদের বিশাল গরিমা কোন দিনই তেমন ছিল না মল্ল রাজাদের । এই বাঁজা অঞ্চলে চাষ
বাসও যে খুব ভালো হোত, তা নয় । তাই সম্ভবত কেউ এঁদেরকে বিশেষ ঘাটায়নি । মানে দখল
টখল করতে আসেনি আর কি ।
-- মানে ছুঁচো মেরে
হাত গন্ধ করতে চায়নি বলছেন ?
-- কতকটা তাই । আর এই
সুযোগে এখানকার মানুষজন মনের সুখে গান-বাজনা-শিল্প চর্চা করেছেন । শুধু টেরাকোটা
কেন, বিষ্ণুপুর ঘরাণার সঙ্গীত বা এই বালুচরি স্বর্ণচরি শাড়ি, এসব কি আর অল্প দিনের
ফসল ? বহু শতকের শিক্ষা, পরিশ্রম ও উত্তরাধিকার জড়িয়ে নেই এর সঙ্গে ? এমনি এমনি
লোকের এত প্রিয় হয়েছে ?
-- বুঝলাম । আজও
বাঁকুড়া জেলায় উচ্চ শিক্ষিতের হার তুলনামূলক বেশি । তাও জানি । কিন্তু....
আমার কথা শেষ না করতে
দিয়েই, বৃদ্ধ আবার শুরু করলেন,
-- আদি মল্লর পিতা
রাজপুত ছিলেন বলে শোনা যায় । মানে বর্ণ হিন্দু । ওদিকে ছেলে আদিবাসীদের রাজা ।
মানে ইতর শ্রেণী । ওই যারা গাছ পাথর পুজো করে আরকি । এই বাঁকুড়ার ঘোড়া তো আসলে ওই
শ্রেণীর মানুষের পূজা উপকরণ । সাঁওতাল বাগদিরা আজও বুড়ো গাছের তলায় রেখে আসে
দেখবেন ।
আদি মল্লর ১৯ তম
উত্তরসুরি, জগত মল্ল আবার ছিলেন পুরো দস্তুর শাক্ত । তিনি স্বপ্নে মা মৃন্ময়ীর
আদেশ পেয়েছিলেন । সেই মতো মায়ের মূর্তি গড়েছিলেন । মন্দির বানিয়ে দিয়েছিলেন । যা
আজও পূজিত হয় । ওই মৃন্ময়ী মন্দিরে রাখা একটি কামান দেখতে পাবেন । যেটি আজও প্রতি
বছর গর্জন করে ওঠে অষ্টমী-নবমীর সন্ধি ক্ষণে । সেই আওয়াজ শুনে সন্ধি পূজায় বসেন
বিষ্ণুপুরের তাবৎ দুর্গা পূজার পুরোহিত । বাংলার সব চেয়ে প্রাচীন দুর্গা পূজা এটি
। হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন । জানা আছে আপনার ?
মানতেই হোল, জানা ছিল
না । বললাম,
-- হাজার বছরেরও বেশি
পুরনো দুর্গোৎসব ? আমরা তো সিল্ভার জুবিলি, গোল্ডেন জুবিলির ঠেলায় অস্থির । মানে
পঁচিশ বছর, পঞ্চাশ বছর । একশো বছরের পুরনো কিছু বাড়ির পুজো আছে বটে । কিন্তু হাজার
বছর ? বাপ রে !
-- নেটে দেখতে পারেন
। এক বর্ণ মিথ্যা বলছি না । আমাদের মৃন্ময়ী
দুর্গার বয়স হাজারের বেশি । যদিও পুরনো মন্দিরটা আর নেই । ভেঙ্গে গেছে । পুরনো
রাজবাড়ির সঙ্গেই । নতুন মন্দির অনেক পরে বানানো । তবু মায়ের পুজোয় ছেদ পড়েনি ।
-- আর এই শামরায় ? রাধা
বিনোদ ? মদন মোহন ? এই কৃষ্ণপ্রেমের ইতিহাস ?
-- এটার সূচনা হাম্বীরের
আমলে । ৪৯তম মল্ল ছিলেন মহাবীর । সম্রাট আকবরের পক্ষ নিয়ে আফগানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
লড়েছিলেন । শোনা যায়, বৃন্দাবন থেকে গৌড় যাওয়ার পথে বৈষ্ণব ধর্ম গুরু শ্রীনিবাস
আচার্যের সর্বস্ব লুঠ করেন তিনি । পরে তাঁরই শিষ্যত্ব গ্রহণ করে, প্রেম ও ভক্তি
রসের পুজারি হয়ে যান । এও আরেক অশোকের কাহিনী । চন্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক হওয়ার গল্প
আমাদের পড়ানো হয় । কিন্তু যুদ্ধ বিশারদ হাম্বীরের বৈষ্ণব হয়ে যাওয়ার কাহিনী কতজন
জানেন ?
.
ফাইভ বা সিক্সে পড়তে,
একবার স্কুল থেকে বিষ্ণুপুর বেড়াতে নিয়ে গেছিল । আমি যাইনি সেবার । বোধহয় জ্বর
হয়েছিল । যারা গেছিল, ফিরে এসে গল্প করেছিল, দলমাদল কামানের । সে নাকি এক মস্ত
কামান । মাঠের মাঝখানে রাখা আছে । যার এক গোলাতে শত্রু পক্ষের হাজার সৈন্য ধরাশায়ী
হয়ে যায় । আর তাই নাকি বিষ্ণুপুরের রাজাদের কেউ হারাতে পারে না ।
তবে রাজবাড়ি দেখে
ওদের পছন্দ হয়নি । মনে আছে, সুব্রত আর বিশ্বরূপ মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল,
-- ধুর, ওটা রাজবাড়ি
না কচু । ভাঙ্গা চোরা পোড়ো বাড়ি । চারদিকে গাছপালা গজিয়ে গেছে । আর সব চেয়ে মজার
ব্যাপার শুনবি ?
আমরা যারা সেবার যেতে
পারিনি, সমস্বরে জানতে চেয়েছিলাম,
-- কী বল, বল ?
উত্তর দেবে কি ? বিশ্বরূপ,
সুব্রত, আশোক, সব হেসে গড়িয়ে পড়ছিল । হাসতে হাসতে যা
বলেছিল, তার মর্মার্থ হল, রাজা মশাইকে ওরা মুড়ি খেতে দেখেছে । বড় কাঁসার জাম বাটি
করে এক বাটি মুড়ি নিয়ে, খাটিয়ায় বসে খাচ্ছিলেন রাজামশাই । সকালের ব্রেকফাস্ট ।
মাথায় মুকুট বা পাগড়ি টাগরি কিছু নেই । পাইক-বরকন্দাজ-সেপাই-সান্ত্রী কিচ্ছু নেই ।
এমনকি, দু’এক জন সুন্দরী রাণীও আশেপাশে ছিল না । অতি সাধারণ ধুতি ফতুয়া পরা, বুড়ো
একটা লোক নাকি বিষ্ণুপুরের রাজা !
ওদের কথা শুনে
আমাদেরও বিশ্বাস জন্মেছিল, ও রাজা টাজা কিছু নয় । স্যাররা আমাদের বোকা বানিয়েছেন ।
ফালতু একটা কামান দেখাতে নিয়ে গেছেন কিনা । তাই এই রাজা রাণীর গল্প ফেঁদেছেন ।
আর এই বিশ্বাসে ভর
করেই আমাদের খারাপ লাগাটা উবে গেছিল । স্কুলের সবার সঙ্গে যেতে না পারার দুঃখ,
অনেকটা লাঘব হয়েছিল, রাজা মশাইয়ের মুড়ি খাওয়ার গল্প শুনে ।
.
এ সেই ’৭৬-’৭৭ সালের
কথা । এখন কি আর বলা উচিৎ হবে ? দোনামনা করতে করতে বলেই ফেললাম ঘটনাটা । ভাবলাম,
অনন্তবাবুর খারাপ লাগবে । ভদ্রলোক বিষ্ণুপুরকে প্রচন্ড ভালবাসেন ।
কিন্তু আমাকে অবাক
করে দিয়ে বুড়ো ভদ্রলোক মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন । তারপর বললেন,
-- ঠিকই, বিষ্ণুপুরের
রাজারা মুড়ি খেতেন বটে । আর এই রাজাদের অত জাঁক জমকও ছিল না । গরীব রাজাই বলা চলে
।
জিজ্ঞাসা করলাম,
-- কিন্তু স্বাধীনতার
পরেও রাজা ছিল ? আইন অনুযায়ী, রাজা কেন জমিদারও তো থাকতে পারে না আর ।
যেন তৈরি ছিলেন
প্রশ্নটার জন্য । বললেন,
-- মল্লভূমের ৬১ তম
রাজা ছিলেন মহারাজ কালিপদ সিংহ ঠাকুর । ১৯৩০ সালে তিনি সিংহাসনে বসেন । স্বাধীনতার
আগে পর্যন্ত তিনিই বিষ্ণুপুরের রাজা ছিলেন । ১৯৮৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয় । মৃত্যুর
আগে অবধি তাঁকে এ তল্লাটের রাজাই বলা হত ।
যদিও মহারাজা সুলভ
কোন কিছুই মল্ল রাজাদের ছিল না কোন দিন । এই রাজারা বরং প্রজাদের সঙ্গে মিলে মিশে
শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করতেন । সঙ্গীত, তাঁত,
টেরাকোটা তো আছেই । তাছাড়া এখানকার শাঁখারি পট্টি, কাঁসা পিতলের কাজ, ডোকরা শিল্প
ও কাঠের কাজ নাম করা ।
আর সর্বোপরি এই
রাজারা ছিলেন প্রজা বৎসল । সুখে দুঃখে প্রজাদের পাশে থাকতেন বলেই না ৬১ পুরুষ ধরে
একটানা রাজত্ব করে যেতে পেরেছেন । ভারতের কটা রাজ বংশের এই কৃতিত্ব আছে ? প্রায়
দেড় হাজার বছর । মামুলি তো নয় !
কথা বলতে বলতে পুরনো
রাজবাড়ির মাঠে চলে এসেছি । এক সময় এখানেই বিষ্ণুপুর উৎসব হত । এখন হয় কলেজ মাঠে । সামনেই
গড় দরজা । বড় এবং ছোট । সুদৃশ্য ল্যাটেরাইট পাথরের তৈরি । দেখে
বেশ দুর্গ দুর্গ অনুভূতি হোল । কিন্তু দুর্গ কই ?
অনন্তবাবুকে জিজ্ঞেস
করতে বললেন,
-- আলাদা করে দুর্গ
গড়েননি এখানকার রাজারা । নিজেদের নিরাপত্তার পাশাপাশি, গোটা শহরটাকেই শত্রুর হাত
থেকে রক্ষা করার কথা ভেবেছিলেন । তাই গোটা বিষ্ণুপুর এক সময় পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিল ।
ওই দেখুন, গড় দরজার সামনে দিয়ে যা এখনও বয়ে যাচ্ছে । শত্রুর আক্রমন হলে জল এবং
কুমির দুইই ছাড়া হত । তাছাড়া কামান বন্দুকের ব্যবহার তো ছিলই ।
ভদ্রলোকের গলার স্বরে
এমন একটা প্রত্যয় আছে, যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় । চারশো পাঁচশো বছর আগেকার কথা
এমন ভাবে বলেন, যেন এই তো সেদিনের ঘটনা । যেন কদিন আগে এলে আমরাও সব দেখতে পেতাম ।
তবু একটা প্রশ্ন না করেই পারলাম না ।
-- আচ্ছা, এই অঞ্চলে
জলের ক্রাইসিস ছিল বলে শুনেছি ? তেমন বড় নদীও তো নেই আশেপাশে । তাহলে পরিখায় জল
ছাড়ার ব্যাপারটা কি......... ?
আমার কথা শেষ করতে
দিলেন না বৃদ্ধ । সোৎসাহে বলে উঠলেন,
-- এতক্ষণে একটা
প্রশ্নের মত প্রশ্ন করেছেন বটে । এই কথাটাই তো বোঝাতে চাইছি আপনাদের । প্রজা বৎসল
মল্ল রাজারা, এখানকার জলের অভাব মেটাতে, সাত খানা বড় দিঘি কাটিয়ে ছিলেন । সেই
পুকুরগুলো আজও শহরের মূল জলাধার । অতয়েব, বুঝতেই পারছেন, পরিখায় জল ছাড়ার গল্পে
একটুও জল নেই ।
বেশ বুঝতে পারছি,
বিষ্ণুপুরের কোন কিছুই খারাপ বলতে রাজি নন বৃদ্ধ । স্বাভাবিক । গাইডের কাজই তো তাই
। সব ভাল জিনিসগুলো দেখিয়ে দেওয়া । রাজস্থান, আগ্রা, দিল্লি বেড়াতে গিয়েও দেখেছি
গাইড যারা থাকেন, অনেক কিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলেন । একটু চেপে ধরলে, ‘রাজা রাজরাদের
খেয়াল’ বলে পাশ কাটিয়ে যান । অনন্তবাবুকে কিন্তু সেরকম পাশ কাটাতে দেখলাম না
একবারও । প্রত্যেকটা বল একেবারে সোজা ব্যাটে খেললেন । যেন ‘লগান’ ছবির আমির খান । গ্রামের
রাজা থেকে প্রজা সবার হয়ে বাজি লাগিয়ে বসে আছেন । খেলায় না জিতলে কারো রক্ষে নেই ।
ইতিমধ্যে আমাদের
মদনমোহন মন্দির, জোড়বাংলা মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির, মৃণ্ময়ী মন্দির ইত্যাদি দেখা
হয়ে গেছে । রাস্তার ধারে এক জায়গায়, হাতে চালানো তাঁতে, স্বর্ণচরি শাড়ি বোনাও
দেখেছি । এই সব দেখতে দেখতে সন্ধে নেম এল । দলমাদল কামানটা দেখা শুধু বাকি । ওটা
আমরা নিজেরাই দেখে নিতে পারবো কাল সকালে । এই বলে বুড়ো ভদ্রলোককে বিদায় দিলাম ।
টাকাপয়সা মিটিয়ে । এক গাল হেসে, সাইকেলে চাপার আগে ভদ্রলোক শুনিয়ে গেলেন,
-- দলমাদল কামানও
তৈরি করিয়েছিলেন মহারাজ হাম্বীর । ১৬০০ খৃষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে । ১২০ টন ওজনের
লোহার আগ্নেয়াস্ত্রটি বানিয়েছিল জগন্নাথ কর্মকার নামে এক মিস্ত্রি । চারশো বছর হয়ে
গেল । রোদ, বৃষ্টি, হাওয়া একটুও জং ধরাতে পারেনি ওই লোহার যন্ত্রে । দিল্লির
মনুমেন্টের লোহার স্তম্ভটির কথা আপনারা সবাই জানেন । নানা রকম গল্প কথা প্রচলিত
আছে ওই স্তম্ভটিকে নিয়ে । অথচ প্রায় সমবয়সী এই কামানটিকে নিয়ে তার সিকি ভাগ উৎসাহও
দেখা যায় না ।
*
বিষ্ণুপুর এসেছি আর
চপ মুড়ি খাব না তাই হয় ? শ্বশুর মশাই বললেন, বিষ্ণুপুর টুরিস্ট লজের কাছে খুব ভালো
চপ বানায় । বছর চারেক আগে এসে খেয়েছিলেন ।
ওমা ! গিয়ে দেখি
দোকানটা খোলেইনি । আশেপাশের বেশিরভাগ দোকানও বন্ধ । জানা গেল, গাজনের মেলা লেগেছে
না । তিনদিন এই রকমই থাকবে ।
জিজ্ঞেস করলাম, গাজন
বলে, চালু দোকান বন্ধ করে মেলা দেখতে ?
উত্তর পেলাম, তাও তো
এটা চরক গাজন । ধর্মরাজের গাজনে এলে তো আরই কিছু পেতেন নাই ।
ধর্মরাজ গাজন যে কবে
হয় জিজ্ঞেস করার আর সাহস পেলাম না । বললাম, তা না হয় বুঝলাম । কিন্তু এখন গরম গরম
আলুর চপ কোথায় পাই ? বিষ্ণুপুর বেড়াতে এসে চপ না খেয়ে ফিরে গেলে ঠাকুর পাপ দেবে না
?
ঠাকুরের পাপ দেবার
কথাতেই হোক, কিংবা টুরিস্ট বলে বুঝতে পেরেই হোক, এবার যেন একটু নড়েচড়ে বসল বেঞ্চিটা
। এতক্ষণ মোটে পাত্তা দিচ্ছিল না কেউ । মোড়ের মাথায় একটা বেঞ্চে জনা চারেক বসে
আড্ডা দিচ্ছে । চপের হদিশ জানতে চেয়ে তাদের দিকেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছি ।
একজন বলে উঠল,
রাসমঞ্চের দিকে একবার দেখতে পারেন । এই রাস্তা ধরে সোজা চলে যান । কাছেই । ওখানে
না পেলে আর কোথাও পাবেন না ।
গাড়ি রেখে হাঁটতে
হাঁটতে চললাম রাসমঞ্চের দিকে । রাস্তায় আলো প্রায় নেই বললেই চলে । অনেক দূরে দূরে
ল্যাম্প পোস্ট । কম পাওয়ারের হলুদ বাল্ব ঝুলছে । দুপাশের দোকান পাটও বেশিরভাগ বন্ধ
। বাড়ির জানালা ভেদ করে যে আলো ছিটকে আসছে তাও হলুদ রঙের । অন্ধকার দূর করার বদলে
বাড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছে এরা । মনে হল ভোল্টেজের
প্রবলেমও আছে এ অঞ্চলে ।
রাসমঞ্চের গা ঘেঁষে
একটা ক্লাব । জনা দশ বারো ছোকরা টিভি দেখছে । সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্ঘশ্রী না কি
যেন, ক্লাব-অনুদানের পয়সায় কেনা । আইপিএলে কেকেআরের ম্যাচ চলছে । তুমুল উত্তেজনা ।
তারই গায়ে কাঠের আগুনে চপ ভাজছেন এক মহিলা ।
ছোট্ট উনানে কালো
লোহার কড়াইয়ে তেল গরম হচ্ছে । ফুটন্ত সর্ষের তেলের ঝাঁজ লাগছে নাকে । চপ বানানোর
কাজে সাহায্য করছে যে, সে নিশ্চয় মহিলার বর । আমাদের দেখে আরো কিছু কাঠ-পাতা আগুনে
গুঁজে দিল । তারপর ছোট ছোট ঠোঙায় কুনকে করে মুড়ি ঢেলে, সবার হাতে ধরিয়ে দিল । ঘরে
ভাজা গোল গোল মিষ্টি মুড়ি । সঙ্গে, গরমা গরম আলুর চপ । আর কাঁচা লংকা ।
আহা চপটা যা ভেজেছে
না ! রাজকীয় । সাধে কি আর বিষ্ণুপুরের রাজা মশাই মুড়ি খেতেন ?
*
আজ তৃতীয়া ।
বেশ বড় চাঁদ উঠেছে আকাশে । দুদিন আগেই ছিল পুর্ণিমা । রাসমঞ্চের গায়ে এসে পড়েছে
হাল্কা চাঁদের আলো । পিরামিডের সিঁড়িগুলো বেশ চেনা যাচ্ছে । খিলান গুলোর মাথার গোলচে
আর্চগুলো চাঁদের আলোয় ফ্যাকাশে হয়ে আছে । নিচের রাসমঞ্চটিতে নিকষ অন্ধকার ।
অন্ধকারের একটাই রং ।
কৃষ্ণ কালো । সেই কালোরও যেন কম বেশি আছে । কোথাও ঘন কালো । কোথাও ফিকে । বাগান
ঘেরা গোটা তল্লাটটা ওই কালো রঙে সেজেছে । আর কোন রং নেই । প্রয়োজনও নেই বোধ হয় ।
এখনো রাস পূর্ণিমায় কালাচাঁদের সঙ্গে রাসলীলায় মাতে গোপিনীরা । অন্ধকার রাসমঞ্চে, ইঁটের থামগুলোর চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচে । চাঁদের আলোয় লুকোচুরি খেলে । গভীর রাতে গোপবালাদের পায়ের নুপূর বেজে ওঠে রুণু ঝুনু । সে কিঙ্কিণী আজও ভক্তের কানে বাজে । ব্যাকুল করে মন ।
যদিও অবিশ্বাসীরা
বলে, আলো পাহারা তুলে দিয়ে প্রশাসন মন্দিরগুলোকে সমাজবিরোধীদের আড্ডা বানিয়ে
দিয়েছে । গোপবালা নয়, ক্রমশ নগরবালাদের লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠছে এই ঐতিহাসিক স্থান ।
চারশো বছরের প্রাচীন
সৌধ চুপ করে দাঁড়িয়ে সব দেখে । কিছু বলে না । শুধু তার অলিন্দ গুলোর মধ্যে দিয়ে
যেতে যেতে, বাতাস বুঝি কিছু বলতে চায় । দীর্ঘশ্বাসের মত সে শব্দ পোড়া মাটির থাম
গুলোর চারপাশে ঘুরতে থাকে । আর ফিস ফিস করে । কেউ সে কথা বুঝতে পারে না ।
*****
Comments
Uthchhi.